
বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ইসলামাবাদী
বহুমাত্রিক কিংবদন্তি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও দার্শনিক মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সুযোগ্য পুত্র শাহাজাহান ইসলামাবাদী। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম। ডা. মাহফুজুর রহমান তাঁর ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম : মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপ ও সার্জেন্ট আলম গ্রুপ, একই গ্রুপের দুটো নাম।’ দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, আনোয়ারা, চন্দনাইশ, বাঁশখালী এলাকার প্রায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রধানত এই দুই গ্রুপের সাথে থেকে কাজ করেছেন।’ মূলত, সার্জেন্ট মহি আলম ছিলেন শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপের ডেপুটি এবং অপারেশন কমান্ডার। যদিও সার্জেন্ট মহি আলমেরও একটি গ্রুপ ছিল। পরে সার্জেন্ট মহি আলম মারা গেলে শাহজাহান ইসলামাবাদী এই গ্রুপেরও প্রধান হন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালীর উপর হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারা বাংলাদেশে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করে। মার্চের শেষে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শাহজাহান ইসলামাবাদী চন্দনাইশ থানার বরমা ইউনিয়নের পশ্চিম বাইনজুরী গ্রামের নিজ বাড়িতে চলে যান। গ্রামেই এসেই প্রথমে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. গোলাম মাওলার সাথে পরামর্শ করেন। এরপর নিজ গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ও ছাত্তার, পাশের গ্রামের ফেরদৌস ইসলাম খান, আহামুদুর রহমান ও আবুল বশরসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেন একটি সক্রিয় গ্রুপ। পিতা মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রতিষ্ঠিত বরকল এস. জেড. উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন।
গ্রুপ প্রতিষ্ঠার পর শুরু করেন অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ। এর অল্প কিছুদের মধ্যে সেই গ্রুপে এসে যোগ দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুরিদুল আলম, ফরিদুল আলম, মঞ্জুর, আলমগীর, গউছ মোহাম্মদ মালেক, মোজাহের, হাবিবুর রহমান, ছবুর, সোলাইমান, কালামসহ আরও অনেকে। যুদ্ধের শেষে দিকে শাহজাহান গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০। এক পর্যায়ে অস্ত্রশস্ত্র বেড়ে যাওয়ায় তা রাখার জন্য বড় বড় বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আর্মস সেন্টার তৈরি করা হইয়াছিল।
শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে বরমা ও বরকল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্ত এলাকা। তাঁর নেতৃত্বে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রায় অধিকাংশ অপারেশনে অংশগ্রহণ করত। বিভিন্ন এলাকা থেকে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার জন্য আনা হতো, আবার প্রশিক্ষণের জন্যও আসতেন। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা, কমান্ডার, গ্রুপ কমান্ডার, এরিয়া কমান্ডার অপারেশনের আগে ও পরে শাহজাহান ইসলামাবাদীর কাছে নির্দেশনা ও পরামর্শ নিতে আসতেন, থাকতেন, আবার চলেও যেতেন।
নিজ গ্রামে যেসকল মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের মধ্যে একজন ফেরদৌস ইসলাম খান। তিনি শাহজাহান ইসলামাবাদী গ্রুপের ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস ইসলাম খান স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার পর চট্টগ্রাম শহর পাকবাহিনীর দখলে চলে গেলে আমি আমার গ্রামের বাড়ি তৎকালীন পটিয়ার (বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলা) বরকলে চলে যাই। কিছুদিন পর রাস্তায় শাহজাহান ইসলামাবাদীর সাথে দেখা হয়। তিনি মুক্তিবাহিনীর একটি গ্রুপ গঠনের কথা বললে আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে যাই। একটি গ্রুপ গঠনের লক্ষ্যে আমরা পাঁচজন প্রথম বৈঠক করি। যার মধ্যে শাহজাহান ইসলামাবাদী, ডা. গোলাম মাওলা, আহমদর রহমান, শহীদ জাহাঙ্গীর আলম (দিলীপ) ও আমি। বৈঠকে শাহজাহান ইসলামাবাদী জানান, তাঁর কাছে ২টি এসএলআর (C-3 Auto Gun), ৩টি গ্রেনেড এবং কিছু গুলি আছে। কিন্তু অপারেশন করতে হলে আরো অস্ত্রের প্রয়োজন। তাই সিদ্ধান্ত হলো, এই অস্ত্রগুলি দিয়ে ছোট ছোট কিছু অপারেশন করবো। সিন্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম আমরা আনোয়ারার খাসগামা ও বৈলতলীতে দুইটি ছোট অপারেশন করি এবং দুইটি অস্ত্র পাই। পরে বৈলতলীর আহমদ সৈয়দের কাছ থেকে আরও দুটি অস্ত্র (একটি এসএমসি ও একটি রাইফেল) সংগ্রহ করি। অধ্যাপক শামসুর নেতৃত্বে একটি গ্রুপ ভারত থেকে চট্টগ্রামে এসে নিস্ক্রিয় বসে থাকতে দেখে আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করি। তারা আমাদের ৭টি রাইফেল ও ১ হাজার ৩০৩টি গুলি দেয়। মোটামুটি অল্প কিছু দিনের মধ্যে আমাদের অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে। এরমধ্যে ক্যাপ্টেন করিমের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়। আমি এবং শাহজাহান ভাই করিম সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য গৈড়লার পোস্ট মাস্টার আহমদ হোসেন সাহেবের বাড়িতে যাই। করিম সাহেব এবং শাহজাহান ভাইয়ের মধ্যে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের সাথে সহযোগিতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তিনি আমাদের অনেক ভাঙতি পয়সা দেন। ওই সময় করিম সাহেবের নিকটও বেশি অস্ত্র ছিল না। পটিয়া ও আনোয়ারার অনেক লোক সেই সময় আমাদের গ্রুপে যোগদান করতে আসলে যাচাই-বাছাই করে শপথবাক্য পাঠ করে যোগদানের বিষয়ে আহমুদুর রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কিছুদিন পর তাঁর (শাহজাহান ইসলামাবাদী) নেতৃত্বে কাজ করতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর অনেক সৈনিক এসে জড়ো হতে থাকেন। এদের মধ্যে সার্জেন্ট মহি আলম, আব্দুস সবুর খান, হাবিলদার আবুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সার্জেন্ট আলম যোগদানের পর তিনিই শাহজাহান ইসলামাবাদীর অধীনে শাহজাহান গ্রুপের অপারেশন কমান্ডার নিযুক্ত হন। তাঁর অধীনস্থ গ্রুপ কমান্ডার মহসিন খানও তার গ্রুপ নিয়ে শাহজাহান ইসলামাবাদীর গ্রুপের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিতে থাকেন।
বদরুল আলম আজাদ ইসলামাবাদী ছিলেন শাহজাহান ইসলামাবাদীর ছোট ভাই। অনেকে বদরুল আলম ইসলামাবাদীকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী বলে উল্লেখ করলেও এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শাহজাহান ইসলামাবাদী নিজ গ্রামে অপরিচিত হয়েও শক্ত অবস্থান করার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল ভাই বদরুল আলম আজাদ ইসলামাবাদীর। শাহজাহান ইসলামাবাদীকে গ্রামের মানুষ চিনতেন না। কারণ, তিনি শহরে থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গ্রামে আসেন।
ডা. গোলাম মাওলা ছিলেন শাহজাহান ইসলামাবাদীর খুব বিশ্বস্ত ও কাছের বন্ধু। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. গোলাম মাওলা শাহজাহান গ্রুপের প্রশিক্ষক ও চিকিৎসক। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র চালনা, অচল অস্ত্র সচল করা, গেরিলা কৌশল শেখাতেন। অসুস্থ, আহত, গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাসহ গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা সেবা দিতেন। শাহজাহান ইসলামাবাদীর মাও ছিলেন একজন মহীয়ষী নারী। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মাতৃ-স্নেহে বুকে টেনে নিয়েছেন। অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়ে সুস্থ করেছেন, রান্না করে খাইয়েছেন, পরনে ভেজা কাপড়ও পাল্টে দিয়েছেন।
শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামে এক ডজনেরও বেশি অপারেশনের তথ্য আমার কাছে রয়েছে। যা এখানে তুলে আনা সম্ভব নয়। খুব শিগগির একটি বৃহৎ খণ্ডে বই প্রকাশ হচ্ছে, যেখানে শাহজাহান ইসলামাবাদীর যুদ্ধ জীবন ও শেষ জীবন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জিরি মাদ্রাসা আক্রমণ, কালারপোল পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ, লাখেরা রাডার স্টেশন আক্রমণ, পটিয়া থানা আক্রমণ, বরমা রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ, আনোয়ারা থানা আক্রমণ।
শাহজাহান ইসলমাবাদাদী এতটাই মহান ও ত্যাগী ছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছিল কি, হয়নি, সে বিষয়টিও জানার চেষ্টা করেননি। অর্থভাবে ভুগলেও গ্রহণ করেননি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। তাঁর সম্পর্কে সংক্ষেপে যদি বলি, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক। যুদ্ধটা ছিল তাঁর কাছে একটা কর্তব্য, দেশ মাতৃকাকে বাঁচানোর দায়িত্ব। দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন, দায়িত্ব পালন করে আবার ফিরে গেছেন।
এক সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির অনুবাদক ও ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছিলেন। পরে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার ও ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯৮৬ সালের আজকের এই (৮ ডিসেম্বর) দিনে মৃত্যবরণ করেন।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক।
মহানগর নিউজ/এআই