
ভাষাসৈনিক মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী
ফেব্রুয়ারি মাস এলে কিছু মানুষ স্মরণ করে ভাষাসৈনিক মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমীকে। নতুন প্রজন্মের অনেকে জানেই না মহান ভাষা আন্দোলনে তাঁর কী ভূমিকা ছিল। এমনকি মিরসরাইয়ে তাঁর মতো একজন ভাষাসৈনিকের জন্ম তা-ও অনেকের জানা নেই। প্রশাসনের তো প্রচার নেই-ই রাজনৈতিক দলগুলোও গরজ করে না এই সাহসী-সংগ্রামী মানুষটিকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার। ফলে প্রচারের কোনো উদ্যোগ নেই, নেই স্মৃতি সংরক্ষণের তাগিদও। এভাবে ইতিহাস -ঐতিহ্য ভুলে গেলে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবে মহান মানুষদের স্মরণ রাখার সংষ্কৃতি।
বাঙালির জাগরণ ও আত্মসন্ধানের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা অপরিসীম। এই আন্দোলন শুধু ভাষা রক্ষার ছিল না একই সঙ্গে ছিল বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয় রক্ষারও। প্রথমত ভাষার অধিকার না পেলে জীবনে অনেক ঘাটতি থেকে যেত। মনের তৃপ্তি মিটতো না। তাই বারবার শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে সেসব ভাষাসৈনিকদের প্রতি যারা বাংলা ভাষার জন্য লড়েছেন। তেমনি একজন ভাষাসৈনিক মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী। যিনি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ সকল ভাষা শহীদের অনুগামী ছিলেন। ছিলেন আন্দোলনকারীদের সহচর। যিনি ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকাতেও ভাষা আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরে এবং চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনকে আরো তীব্রতর করে তোলে।
ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিক মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী ২ নভেম্বর, ১৯২৮ সালে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নের দেওখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা গোলাম রহমান ছিলেন খ্যাতিমান আলেম। আহমেদুর রহমান সাহেবদী নগর প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে মিঠাছড়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। পরে তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।
একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ হয়ে সুবিধাবাদীদের মত পড়ে থাকেননি আজমী। বাংলা ভাষার জন্য আপ্রাণ লড়ে গেছেন। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি ছিলেন এই ভূখণ্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল তাঁর।
বাল্যকালেই আহমেদুর রহমান আজমীর চিন্তা-চেতনায় রাজনীতির বীজ রোপিত হয়। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল বাম রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন সারাজীবন। ব্যতিক্রম ও ঘটনাবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন আহমেদুর রহমান আজমী।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মাদ্রাসায় অধ্যায়নকালে তিনি ভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। পরবর্তীতে প্রগতিশীল আন্দোলনে জড়িত হন। ক্লাস শেষে হাটহাজারী থেকে প্রতিদিন চলে আসতেন চট্টগ্রাম শহরে। শহরে এসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য অনুষ্ঠিত নানা সভা-সমাবেশে অংশ নিতেন। রাতের বেলায় পোস্টার লিখতেন এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে রাত্রিযাপন করতেন। প্রতিদিন সকালে হাটহাজারী গিয়ে মাদ্রাসায় ক্লাস করতেন।
১৯৫২ সালে তিনি ভাষা-আন্দোলনের সক্রিয় ও একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে চট্টগ্রামের সকল কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। তখন তিনি বামপন্থি-কর্মী হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রামের অনেক সাংস্কৃতিককর্মী তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ঢাকায় ছাত্র হত্যার খবর চট্টগ্রামে পৌঁছালে চট্টগ্রাম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং প্রতিবাদ সভা ও মিছিল শুরু করে। প্রতিটি সভা-সমাবেশের আয়োজন ও বাস্তবায়নে আহমেদুর রহমান আজমী ছিলেন খুবই তৎপর। একুশের আন্দোলনপরবর্তী পর্যায়েও তিনি বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা পালন করেন।
রাজনীতি শুরু করে ছাত্র ইউনিয়ন, পরে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ, বাকশাল সর্বশেষ তিনি গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থেকে পালন করেছেন অনন্য ভূমিকা। তিনি তাঁর এলাকা মিরসরাইয়ে সংগঠনের কার্যক্রম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। মিরসরাইয়ে ওনার সহচর ছিলেন অধ্যক্ষ মেজবাহুল আলম, সৈয়দুল হক, মিঠাছরা স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষক কেষব চন্দ্র মজুমদার, জয়নাল আবেদীন, ডা. মাজহারউল ইসলামসহ আরও অনেকে।
১৭ ই ফেব্রুয়ারি ভাষার মাসে এই ভাষাসৈনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তি প্রয়াত হন। এই আমৃত্যু বিপ্লবী চিরদিন বেঁচে থাকবেন গণমানুষের হৃদয়ে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী
এআই