
বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী
আজ ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের অন্যতম সহযোগী বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর ১১২তম জন্মবার্ষিকী।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদ যুদ্ধের অকুতোভয় এই যোদ্ধা আজীবন অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ ও মানবতাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু এই মহান বিপ্লবীর মৃত্যুর ৮ বছর পরও স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে মহাকালের সারথী বিপ্লবী বিনোদ বিহারীর স্মৃতি রক্ষার্থে অন্তত স্মৃতিফলক স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন সচেতন নাগরিক সমাজ।
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার উত্তরভূর্ষি গ্রামে ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি বিনোদ বিহারী চৌধুরীর জন্ম। যে বয়সে সমবয়সীদের সঙ্গে আনন্দ উল্লাস আর খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকার কথা সে সময়ে তিনি মাস্টারদা সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, মধুসূদন দত্ত, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস প্রমুখ বিপ্লবীদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। এরপর শুরু হয় তাঁর বিপ্লবী জীবন। চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল পুলিশ অস্ত্রাগার আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের দুটি অস্ত্রাগার দখলের পর মাস্টারদা সূর্য সেনকে বিপ্লবী সরকারের প্রধান ঘোষণা করে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান নেন। ২২ এপ্রিল ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে তিনি গুরুতর আহত হন। ব্রিটিশ সৈন্যদের মেশিনগানের গুলি তার গলাভেদ করে বেরিয়ে যায়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি গভীর রাতে সহকর্মীদের সাহায্যে পাহাড় থেকে নেমে গ্রামের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। গুলির ক্ষত শুকাবার পর ঢাকায় গিয়ে আত্মগোপন করেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে গ্রেফতারের জন্য শুধু হুলিয়া জারি করেননি, জীবিত অথবা মৃত ধরে দেয়ার জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। ১৯৩৩ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকায় গ্রেফতার হন তিনি। বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সে প্রায় ৫ বছর চট্টগ্রাম জেল, কলিকাতা প্রেসিডেন্সি জেল, দেউলী ডিটেনশন ক্যাম্প ও বহরমপুর জেলে বন্দি থাকার পর ১৯৩৮ সালের ২৭ এপ্রিল মুক্তি লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে আবারও তাঁকে এক বছর গৃহবন্দি করে রাখা হয়। দুবছর পর তাঁকে ফের গ্রেফতার করে চট্টগ্রাম জেল, হিজলী বন্দি শিবির, ঢাকা জেল, খোকসা বন্দি শিবিরে আটক রাখা হয়।
২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন জীবনভর অন্যায়, অবিচার, শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ বিপ্লবী। তিনি নিজের জীবনের সবটুকু সময় ব্যয় করেছেন এদেশের মানুষের জন্য। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন সব সময় সোচ্চার। এদেশে নিজের আপন কেউ না থাকলেও নিজের দেশের মাটি আঁকড়ে ধরে ছিলেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। যে মানুষ সারাটা জীবন এদেশের মানুষের জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে গেলেন তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সরকার থেকে গ্রহণ করা হয়নি কোনো উদ্যোগ। এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক সমাজ।
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন মহানগর নিউজকে বলেন, বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকীতে আমরা তাঁর নামে একটি সড়ক করার দাবি করেছিলাম। প্রশাসন থেকেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।কিন্তু আজও সে আশ্বাস রক্ষা করা হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পরেও এই দাবি অনেকবার করা হয়েছে। বরাবরই প্রশাসন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। ১১২তম জন্মবার্ষিকীতে অন্তত প্রশাসনের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া এই মহান বিপ্লবীর নামে যেন স্থায়ী স্মৃতিফলক স্থাপন বা সড়ক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমান প্রজন্মের উচিত এই মহৎ কাজে এগিয়ে আসা। তা না হলে ইতিহাসের পাতা থেকে এই মহান বিপ্লবীর নাম মুছে যাবে।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত জানান, বিনোদ বিহারী চৌধুরীর নামে কোনো সড়ক বা স্মৃতিফলক না থাকা আমাদের দেশের জন্য অপমানজনক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কৈশোর বয়সেই তিনি অস্ত্র ধরেছিলেন। জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত অবিচল থেকেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অর্থের অভাবে যখন শুনেছি নিজের ঘরও তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন, তখন আমরা খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। এক্ষুণি প্রশাসন থেকে যদি তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো উদ্যোগ না নেয় তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাকে মনে রাখবে না। আমরা চাই দেশ ও জাতি গঠনে তাঁর যে অবদান সেটা বেঁচে থাকুক পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রিতা দত্ত বলেন, যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন দেশকে নিয়েই ভেবেছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছেন উচ্চকণ্ঠে। আর্থিক অনটনে থাকা স্বত্ত্বেও দেশের মাটি ছেড়ে যাননি। নিজের বাড়ি ‘বিপ্লবকুটির’ বিক্রি করে দিলেও দেশের টানে কলকাতায় থাকা একমাত্র ছেলের কাছেও যাননি তিনি। তাঁর নামে স্থায়ী স্মৃতিফলক না থাকা দুঃখজনক।
আইসি/এসএ