বুধবার ২৯ নভেম্বর ২০২৩

| ১৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
০৮:২৭, ৬ ডিসেম্বর ২০২১

ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন 

পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ 

প্রকাশের সময়: ০৮:২৭, ৬ ডিসেম্বর ২০২১

ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন 

পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ 

ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের স্বপ্ন পূর্বেই দেখেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানে পরিণত হয়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে উজ্জীবিত হয়েছে গোটা জাতি। ইংরেজ আমলে বাংলা ভাষাভাষি এ বিশাল এলাকাটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ ছিলো। তৎকালীন সময়ে যা ইংরেজিতে ‘Bengal’ নামে অভিহিত হত। তখন থেকেই এই প্রদেশটি ‘বাংলা’ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। 

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘দুর্মর’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ।’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি

চিরদিন তোমার আকাশ,

তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’  

করাচীতে ১৯৫৫ সালে পাকিস্থান গণপরিষদের ধারা বিবরণীতে বক্তৃতায় শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্টভাবে বললেন, ‘মাননীয় স্পিকার, আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, ওরা (পাকিস্থান সরকার) ‘পূর্ব বাংলা’ নাম বদলিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করতে চাচ্ছে। অথচ, আমরা বার বার এই দাবিই করেছি যে, এখন এর নাম শুধু ‘বাংলাদেশ’ করা হোক। বাংলাদেশ শব্দের একটি ইতিহাস রয়েছে এবং এর নিজস্ব ঐতিহ্য বিদ্যমান। আপনারা নাম বদলাতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে গণভোট নিতে হবে। যদি আপনারা এই নাম বদলাতে চান, তাহলে আমাদের বাংলায় ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা এই ধরনের পরিবর্তন মেনে নিবে কিনা।’ 

‘চল্লিশ থেকে একাত্তর’ নামক বইয়ে এম আর আখতার মুকুলের ভাষ্যমতে—— 

‘আলোচনার এক পর্যায়ে এসে মুজিব ভাই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করলেন। বললেন, আমার মনে অনেক প্রশ্ন। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার সময় পাঞ্জাব এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি প্রদেশ দুটিও খণ্ডিত হয়ে গেছে। এরপরেও বিরাট ‘কিন্তু’ রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরা কেউ এই নামটা ছাড়ছে না। কেননা এই নামটার সাথে পাঞ্জাবি ভাষাভাষীদের জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে। এ জন্য আজও পর্যন্ত পাঞ্জাব (পি) এবং পাঞ্জাব (আই) শব্দটি চালু রয়েছে। 

অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এরকম ব্যতিক্রম কেন? বিভক্ত বাংলার ভারতীয় অংশকে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ এবং পাকিস্তানের অংশকে ‘পূর্ববঙ্গ’ হিসাবে আখ্যায়িত করে হাজার বছরের ‘বাংলাদেশ’ এই আদি নামটি দু’দলই ছেড়ে দিয়েছে। এখন আবার ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভুলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে প্রস্তাবিত সংবিধানে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামকরণ করতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি তা হতে দিব না। ভারতীয় বাঙালিরা তাদের এলাকার নামবদলের কোনোরকম আন্দোলন শুরু করার আগেই আমাদের জন্মভূমির নাম ‘বাংলাদেশ’ করবোই। না হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক বিলম্ব হয়ে যাবে।” 

১৯০৫ সালের পর থেকেই এ অঞ্চলটি ‘পুর্ব বাংলা’ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ পরবর্তী সময়ে দুঃখজনকভাবে এ অঞ্চল কিছু সময়ের জন্য ‘পুর্ব-পাকিস্থান’ নামে পরিচিত হয়। ১৯৬৯ সালে, শুরু হয় আইয়ূব খান পতন আন্দোলন তখন ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ধারণাটি প্রকৃষ্ট রূপ ধারণ করে। সেসময় গণঅভ্যুত্থানে একটি স্লোগান নিয়মিতই দেয়া হতো; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ অর্থাৎ এ অঞ্চলকে অনেকেই মনে-প্রাণে 'বাংলাদেশ' হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটি ভাষণের পর থেকেই ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের দাবির উত্থান হয়।  

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ’ নামটি চূড়ান্ত করেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। আওয়ামী লীগের নেতারা ওই বৈঠকে বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নামটি প্রস্তাব করলে তাতে সবাই একবাক্যে সায় দেন। 

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে এই ঘোষণার উদ্ধৃতি রয়েছে। ওইদিন আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে “বাংলা” কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র “বঙ্গোপসাগর” ছাড়া আর কোনও কিছুর নামের সঙ্গে “বাংলা” কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম “পূর্ব পাকিস্তান” এর পরিবর্তে শুধুমাত্র “বাংলাদেশ”।’ 

পরদিন ৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের খবর ছাপা হয়। ৩০ লক্ষ শহিদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়, সেসময় সাংবিধানিকভাবে এদেশের নাম হয় ‘গণপ্রজান্ত্রিক বাংলাদেশ’। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে গর্বিত দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। 

জয় বাংলা। 

 

লেখক; কলামিস্ট, সংগঠক

কেডি