
সদ্য প্রয়াত তোয়াব খান। সুদীর্ঘ সাংবাদিকতার জগতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক মহানায়ক। আমার মতো সামান্য এক সাংবাদিকের পক্ষে তাঁর ঐশ্বর্য-সমৃদ্ধ পেশাগত জীবন মূল্যায়ন করা সত্যিই কঠিন। নামেই যাঁর সর্ববিধ বিশেষণ। অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য সেখানে প্রভাব প্রতিপত্তির বিষয়ও থাকে না। সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার ব্যাপক আকাঙ্ক্ষা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বে ভর্তি হলাম কিছুটা মনোক্ষুণ্ন হয়ে। তবে খুব বেশি নিরাশও হইনি। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজ বিজ্ঞানী ডক্টর অনুপম সেন স্যারকে। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সে অবধি সাংবাদিকতা বিভাগ খোলাই হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই শুধু এই ব্যতিক্রমী বিষয়টির বিভাগ ছিল। তবে ছাত্রজীবন থেকেই তোয়াব খান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, কে. জি. মুস্তফা এমন সব বিদগ্ধ সম্পাদকদের লেখা পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। আর সাংবাদিকতা বিষয়টির প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করতে না পারার কষ্টটা অনেকটাই উপশম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পরীক্ষা শেষ করার পর পরই। তখন রেজাল্টও বের হয়নি।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি যোগ দিলাম চট্টগ্রাম থেকে সদ্য প্রকাশিতব্য ‘দৈনিক পূর্বকোণে’র শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে। সম্পাদক হয়ে এলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক কে. জি. মোস্তফা। শুরু হলো পেশাগত জীবনের সূচনা লগ্ন। পরবর্তী ২ বছরের অভিজ্ঞতা লাভ করার সময়েই বিয়ে হয়ে আরেকজনের ঘরণী হলাম।
সে সব বিষয় এখানে একেবারেই আলোচ্য নয়। শ্রদ্ধাভাজন তোয়াব খানকে নিয়েই আজকে আমার নিবেদন, সমর্পণ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কোন কিছু শুরু করার আগেও কিছু সূচনা করা যায়। যেমন সন্ধ্যাকালীন প্রদীপ জ্বালানোর আগে সারা দিনের সলতে পাকানো। রবীন্দ্র ভক্ত মানুষ আমি। তাই সঙ্গত-অসঙ্গত কারণে কবিগুরু এসেই যান। আমার এমন সম্মানিত ও গৌরবোজ্জ্বল কিংবদন্তিকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য মাত্র ৬ বছরের। সেই ৬ বছরেই এক বর্ণাঢ্য, আলোকিত মানুষের সাহচর্য পাওয়াও সাধারণ জীবনের পরম প্রাপ্তি।
২০১৬ সালের ৯ মার্চ আমার জনকণ্ঠে যোগ দেওয়া এক দুঃসহ সময়ের চরম ক্রান্তিকালে। তবে তার আগে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হওয়া ‘দৈনিক জনকণ্ঠে’র সাড়ম্বরে অভ্যুদয় বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের এক নবযুগ তো বটেই। শুধু কি তাই? নিত্যনতুন সৃজনশীল সংবাদ পরিবেশনই শুধু নয় ফিচার পাতা ছাড়াও সাহিত্য সাময়িকীর নবতর কলেবর সারাদেশে চমক সৃষ্টি করার মতো এক অনন্য সংবাদ মাধ্যম।
মিডিয়ার ভুবনে এক আলোকোজ্জ্বল অধ্যায়ই শুধু নয় বরং সব সংবাদপত্রকে টপকে একেবারে প্রথম স্থানে চলে আসাও এক অবধারিত অন্য রকম সাংবাদিকতার নবতর নিশানা। শুধু কি ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ ১ নম্বরে উঠে এসেছে তা কিন্তু নয়? অসংখ্য যোগ্য ও প্রজন্মের সাংবাদিককে নিজের মতো তৈরি করে দিয়ে যেন ঘটালেন আর এক আলাদা মাত্রার বিপ্লব। শুধু সু-সাংবাদিকতাই নয়, নীতি, নৈতিকতা, দুঃসাহস, দেশের প্রতি মমত্ববোধ, মুক্তিযুদ্ধের সমৃদ্ধ চেতনাকে সমুন্নত রাখা সবই যেন এক অসাধারণ সংবাদপত্রের মহানায়কের অবিস্মরণীয় কীর্তিময় সফলতা। নির্মোহ আবেগে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ছাড়াও ফিচার পাতাকে নিত্যনতুন আঙ্গিকে ব্যতিক্রমী রূপ দেওয়াও তোয়াব খানের নজরকাড়া সফলতা।
এখানে যোগ দেওয়ার আগে সব কিছু জানার কোন সুযোগ ছিল না। তবে দূর থেকে দেখেছি এক নতুন সংবাদ মাধ্যম কি মাত্রায় সারাদেশ মাতিয়ে এবং দাপিয়ে বেড়ায়। সুযোগ এসে গেল একদিন। তাও এক ঝড়-ঝাপটার চরম আকালে। ২০১৬ সালের ৯ মার্চ জনকণ্ঠে আমার প্রথম দিনের সূচনা। আজও স্মরণ চেতনায় গেঁথে আছে। ‘অপরাজিতা’ পাতা দেখতে হবে এভাবেই আমাকে নিয়োগ দেওয়া হলো। আমি যোগ দেবার আগের দিনই ছিল ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। ৯ তারিখ দেশের প্রথম সারির সব পত্রিকায় এ নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ এমনকি ফিচার পাতায়ও সংশ্লিষ্ট দিবসের কলেবর সাজানো গোছানো হয়েছে।
এই মুহূর্তে মনে পড়ছে আর এক প্রয়াত দক্ষ, অভিজ্ঞ সাংবাদিক নিয়ামত হোসেনের কথা। নিয়ামত ভাই এসে বললেন, একটা সম্পাদকীয় লিখতে হবে ৮ মার্চ নারী দিবসের প্রেক্ষাপটে, তোয়াব ভাই বলেছেন। আমি লেখার জন্য প্রস্তুতি নিতেই নিয়ামত ভাই সতর্ক করলেন, সাবধানে লিখবেন, উনি কিন্তু সবার সম্পাদকীয় নেন না। এটা কিন্তু আপনার পরীক্ষা। ভয়ে শঙ্কায় লিখতে বসলাম সম্পাদকীয়। তোয়াব খানের কোন নির্দেশ কিংবা পরামর্শ লক্ষ্যই করলাম না। শুধু দেখলাম সময় মতো সম্পাদকীয়টা জনকণ্ঠে ছাপানো হয়েছে। কেমন যেন জড়সড়ো ভাবটা কেটেও গেল। আমাকে আর ভাবতেও হয়নি। অপরাজিতায় লেখা যাওয়ার আগেই ২/১টা সম্পাদকীয় জনকণ্ঠের নির্দিষ্ট জায়গায় স্থান পেল।
আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সেই কিংবদন্তি, অসাধারণ সম্পাদককে। যিনি আর কখনও আমার পরীক্ষা নেননি। আমি অতখানি যোগ্যও ছিলাম না। যে সম্মান আর স্বাধীনতা পেয়েছি তোয়াব ভাইয়ের কাছে। কিছু টুকরো স্মৃতিময় ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। আগেই বলে রাখি কৃতিত্ব আমার নয় এই অভিজ্ঞ, দক্ষ, অকুতভয় সম্পাদকই তাঁর হৃদয়ের প্রসারতা, পাণ্ডিত্যের নমনীয়তা এবং চারিত্র্যিক ঔদার্যে আমার সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতিকে সেভাবে আমলে নেনইনি। বরং চেয়েছিলেন, আমি যেন নিজের মতো করে তৈরি হই। আর পরামর্শ, উপদেশ, নির্দেশ দেওয়ার তো তিনি রইলেনই। সময়ে তাও দিতে দ্বিধাহীন থাকতেন।
অপরাজিতা পাতার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আমার স্বল্প জ্ঞানের পরিধিতে তার বৃহদাকার নির্দেশনায় কলেবর বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। পিছন ফিরে একবারও তাকাতে হয়নি। নিয়মিত সম্পাদকীয় লিখে যেতাম। এরই মধ্যে ডেকে বললেন, চতুরঙ্গ আর সাময়িকীতে যেন লেখার চেষ্টা করি।
মার্চ মাসে আমি যখন জনকণ্ঠে আসি তার আগের মাস ছিল ফেব্রুয়ারি। অমর একুশে গ্রন্থমেলার অনন্য সময়। তখন অনেকেই তাদের সদ্য প্রকাশিত বই পাঠাতেন উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানের কাছে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবীণ ও বিখ্যাত লেখকের বইও থাকতো। আমাকে ডেকে সেসব বই রিভিও করতে দিতেন। আমি লিখে তোয়াব ভাইয়ের কাছে নিয়ে যেতাম একটু পড়ে দেখতে। দেখতেন না, বলতেন ছাপা হোক তারপর দেখব। কিন্তু অনেকেরই কাছে শুনেছি যেকোনো নতুন কিছু ছাপার আগে একবার অন্তত দেখে নিতেন। আমাকে কখনও ডাকেননি। পরবর্তীতে সেটা পত্রিকায় দেখতাম। মূলত চতুরঙ্গের লেখার বিষয় আমি নিজেই নির্বাচন করতাম। লিখে তাঁকে দেখাতাম। প্রথম প্রথম দেখতেনও। কিন্তু পরে বলতেন আর দেখাতে হবে না- দুলাল বাবুকে দিয়ে দেন, ছাপার পর দেখব।
তোয়াব ভাই নিজে ডেকে আমাকে দিয়ে ৩টা লেখা লিখিয়েছিলেন। ১টা সাময়িকীর জন্য অন্য দুটা চতুরঙ্গের জন্য। মধ্যযুগীয় বর্বরতায় বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যা। এ লেখাটা কিন্তু তোয়াব ভাই আগেই পড়েছিলেন। অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় তো। কিছু হয়তো সম্পাদনা করেও ছিলেন। জানতেও পারিনি। পরের দিন সেটা পত্রিকায় ছাপা হয়।
১৮২০ সালে জন্ম নেওয়া উনিশ শতকের প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগারের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী ২০২০ সালে আবার আমার ডাক পড়ল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ওপর একটা লেখা লিখতে হবে। আনন্দ বাজার পত্রিকার প্রিন্ট বের করা হলো। ততদিনে আমি তোয়াব ভাইকে জেনে বুঝে নিয়েছি। সসংকোচে বললাম, অন্যভাবে কি লিখতে পারি? তাকালেন আমার দিকে। বললেন কিভাবে? উত্তর দিলাম বিদ্যাসাগরের ওপর সবচেয়ে দামী বই ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’ লিখেছেন বিনয় ঘোষ। সে বই আমার পড়া আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘চারিত্র্য পূজা’ পড়েছি আর মধুসূদনের কবিতা জানা আছে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে। স্মিত হাস্যে বললেন, একেবারেই নিজের মতো করে লিখবেন। পড়েও দেখলেন না, সরাসরি ছাপা হলো।
অন্য এক দিনের কথা মনে পড়ছে। ‘পাহাড় ধস-প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নিয়ে চতুরঙ্গের জন্য একটি লেখা তাকে দেখালাম। চোখ বুলিয়ে বললেন, পাহাড় নিয়ে সাহিত্য করা হয়েছে। তবে এটাই ছাপা হবে। এমন মানবিকতা, চৈতন্যের উদারতা, অন্যকে মর্যাদা দেওয়ার অকৃত্রিম নিষ্ঠায় সেদিন যেন আমি উতরেও গেলাম।
আর একবার নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের কোন এক জন্মবার্ষিকীতে আমাকে লেখার পরামর্শ দিলেন। সেখানেও বললেন, আপনার নিজের যদি জানা থাকে সেভাবেই লিখতে পারেন। এমন অভাবনীয় স্মৃতিগুলো ভোলা কখনও কি সম্ভব? এক সমৃদ্ধ ভুবনের আধুনিক স্থপতি যিনি জ্ঞানে, গরিমায়, সৃজন দক্ষতায় সংবাদপত্রের নিত্যনতুন দিগন্ত উন্মোচন করছেন তেমন এক বলিষ্ঠ পথিকৃৎ সামান্য এক সংবাদ মাধ্যম কর্মীকে এতখানি স্বাধীনতা, সুযোগ আর নিজের মতো লেখাকে অধিকার হিসেবে বিবেচনায় আনছেন সত্যিই বিস্ময়কর এক প্রতিভাদীপ্ত মনন তো বটেই। এতখানি যোগ্যতম ছিলেন আমাদের ধরাছোঁয়ার একেবারে বাইরে। তাই কারও ক্ষুদ্র ক্ষমতাকে কখনও উপেক্ষা কিংবা অবজ্ঞা করেনইনি। এ জন্যই শুধু জনকণ্ঠ নয় তাঁর হাত ধরে তৈরি হয়েছে সংবাদপত্রের নবতর ইতিহাস এবং অসংখ্য দক্ষ ও মানসম্মত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
সদ্যপ্রয়াত এই আলোকিত ব্যক্তিত্ব কখনও ছাই চাপা আগুনের মতো থাকেননি। দ্যুতি বিচ্ছুরিত হতো যেন তার চারপাশ ঘিরে। সুদর্শন, স্মার্ট এই অনন্য প্রাণপুরুষ নিয়তই নিজেকে শাণিত করেছেন দুঃসাহসিক মনোবল আর নির্লোভ, নির্মোহ চেতনায়। আর সংবাদপত্রের মহিমান্বিত জগতকে আলোর ঝলকানিতে ভরিয়েও তুলেছেন।
লেখক : সাংবাদিক
এআই