
জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে তার অন্যতম একটি নীতি হলো, ‘আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা’ এবং সেখানে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যর একটি হলো ‘শ্রেণি কার্যক্রমে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা’। প্রযুক্তি ব্যবহারের যুক্তি এখন সর্বজনগ্রাহ্য। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির যে দিকটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে সেটি হলো ফ্রিল্যান্সিং। একটা মানুষের যেকোনো দক্ষতাকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে তা আয়ের মাধ্যমে রূপান্তরিত করার এর চেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
UNESCO কর্তৃক গঠিত International Commission on Education for Twenty-First Century-এর প্রতিবেদনে ICT-কে একবিংশ শতাব্দীর জন্য একটি আবশ্যকীয় দক্ষতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদেরকে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে প্রস্তুত করার লক্ষ্য থেকে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের শিক্ষাক্রমে নতুন বিষয় হিসেবে ICT অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২–এ মাধ্যমিক স্তরে একটি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সেখানে ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং নিয়ে কথাও উল্লেখ আছে।
আইসিটির নানান খাত আছে। কিন্তু জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে সহজ পদ্ধতি আপাতত ফ্রিল্যান্সিং-ই। হ্যাঁ জোর দিয়েই বলছি সকল তথ্য, তত্ত্ব ও উপাত্ত নিয়ে।
গ্লোবাল গিগ ইন্ডেক্স ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৭% যা বিশ্বের খুব অল্প দেশেই হয়েছে ৷ প্রযুক্তিখাতে এটা আমাদের একটা বড় অর্জন যা ফ্রিল্যান্সিং এর দ্বারা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা দেশের অর্থনীতিতে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে৷ বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের যে পরিমাণ আয় হয় তা সরকার রেমিটেন্স আকারে পায় ৷ বাংলাদেশের তথ্য ও প্রযুক্তি অধিদপ্তর এর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের প্রায় প্রতি বছর ১০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি রেমিটেন্স আসে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর থেকে ৷
অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিউটের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিংয়ে বিশ্বে দ্বিতীয়। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিএফডিএস) জানিয়েছে, দেশে সক্রিয় ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা দেড় থেকে দুই লাখ। ২০১৭ সালে অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট বলেছিল, বাংলাদেশে সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার আছে। তবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) জানায়, অক্সফোর্ডের এই তথ্য বিশ্বের সব বড় বড় ফ্রিল্যান্সিং সাইটের হিসাব থেকে নেওয়া। এর বাইরেও সরাসরি ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করছেন অনেক ফ্রিল্যান্সার। অর্থাৎ মোটাদাগে তরুণদের একটা বড় অংশ বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত আছে এবং দেশের অর্থনীতিতে এক বিশাল ভুমিকা রাখছে।
এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যাদের বিশাল একটি তরুণ জনগোষ্ঠী আছে। এই বিশাল তরুণ ও শক্তিশালী জনসম্পদ এখনো এই ফ্রিল্যান্স বাজারের সম্ভাবনা নিয়ে পুরোপুরি অবগত নয়।
মানবসম্পদ হচ্ছে একটি দেশের সবচেয়ে সম্পদ। শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তিকে বলা হয় মানব মূলধন। কারিগরি শিক্ষা দিয়ে জনগণকে দক্ষ করে তুললে তা হবে সবচেয়ে বড় অর্জন। একটি দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ধনী হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, দেশটি সমৃদ্ধিশালী বা উন্নত হবে। বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে, এমন কোনো সম্পদ নেই, যা সেখানে নেই। যেমন— আফ্রিকার ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো বা সুদানের কথা বলা যেতে পারে। নাইজেরিয়া পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। অ্যাঙ্গোলাও তেলসমৃদ্ধ। কিন্তু দরিদ্র। লাতিন আমেরিকার ব্রাজিল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম দেশ। কিন্তু দীর্ঘকাল শাসনকারীরা শিক্ষাকে গুরুত্ব না দেয়ায় দেশটিতে কাঙ্খিত অগ্রগতি হয়নি। এখন অবশ্য শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া শুরু করেছে দেশটি।
সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ের মতো দেশ দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়েছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, যেমন— জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি রাষ্ট্র গুরুত্ব দিয়েছে মানবসম্পদে। এ দেশগুলো শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আরো স্পেসিফিকভাবে বললে বলতে হয় তারা প্রযুক্তিগত শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। শুধু শিক্ষার হার বাড়ালেই হবে না। জানতে হবে কী ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে গ্র্যাজুয়েট লেভেলে কারিগরি শিক্ষায় পাসের হার মাত্র ৩ শতাংশ, অবশ্য সরকার বলছে ১০ শতাংশ, কিন্তু এটি ভারতে ২৭ শতাংশ, নেপালে ২৩ শতাংশ, শ্রীলংকায় ৪০ শতাংশ এবং উন্নত দেশে ৬০ শতাংশের বেশি। এ থেকে বোঝা যায়, এ দেশগুলোর উন্নতির সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার সম্পর্ক কী। আমাদেরও বুঝতে হবে গলদটা কোথায়।
তবে আইসিটি খাতকে আরো গতিশীল করতে এবং ফ্রিল্যান্সিংকে উৎসাহিত করতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ ও পদক্ষেপ যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এই উদ্যোগ আরো বেগবান হবে যদি রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দক্ষ করে তাদেরকে মানবসম্পদে পরিণত করা যায়। বাংলাদেশি তরুণরা অনেক আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে। আপওয়ার্ক, ফাইভারের মত ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটপ্লেসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশি তরুণ ফ্রিল্যান্সরা, গুগলের মত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাচ্ছে বাংলাদেশি তরুণরা। এর চেয়ে সুখকর আর কী হতে পারে! শুধু ফ্রিল্যান্সিং দিয়েই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন এক মাইলফলক তৈরি হতে পারে, যা একাধারে রাষ্ট্রকে স্বনির্ভর করে সমুন্নত রাখবে এবং দেশের বেকারত্বকে শুন্যের ঘরে নামিয়ে আনবে।
লেখক :
সত্যজিৎ চক্রবর্ত্তী
ক্যারিয়ার কনসালটেন্ট
প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ ক্যারিয়ার ক্লাব
লেখক, উদ্যোক্তা ও কর্পোরেট ট্রেইনার
চেয়ারম্যান, নিউক্লিয়াস গ্রুপ
এআই