সোমবার ০২ অক্টোবর ২০২৩

| ১৬ আশ্বিন ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
১৩:৩২, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

শরীফুল সাগর

আপনিও কি বৃদ্ধ বয়সে এই মনোকষ্টের ভার নিতে পারবেন!

প্রকাশের সময়: ১৩:৩২, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

শরীফুল সাগর

আপনিও কি বৃদ্ধ বয়সে এই মনোকষ্টের ভার নিতে পারবেন!

দেশজুড়ে আলোচিত ঘটনা, রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবু মোহসিন খান (৫৮) ফেসবুকে এসে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন।

বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাত নয়টার পর তার নিজ বাসায় এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।

গতরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের একাউন্টে লাইভে এসে তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় থাকি, আমার বয়স ৫৮ বছর, কোনো একসময় আমি খুব ভালো ব্যবসায়ী ছিলাম। বর্তমানে আমি ক্যানসার রোগে আক্রান্ত। এখন আমার কোনো ব্যবসা বা কোনো কিছুই নেই। আজকের লাইভে আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতা আপনাদের জানানো। এ অভিজ্ঞতা থেকে আপনারা হয়ত অনেক কিছু জানতে পারবেন, সাবধানতা অবলম্বন করবেন। গত ৩০ তারিখ আমার খালা মারা যান। ওনার একটিমাত্র ছেলে, কিন্তু মা মারা যাওয়ার খবরে পেয়েও সে দেশে আসেনি। এ বিষয়টি আমাকে অনেক দুঃখ দিয়েছে। আমার একটা ছেলে আছে, সে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে, আমি আমার বাসায় সম্পূর্ণ একা থাকি। খালা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার ভেতরে ভয় ঢুকে গেছে। আমি যদি আমার বাসায় মরে পড়ে থাকি, আমার মনে হয় না এক সপ্তাহেও কেউ জানতে পারবে’।

তিনি আরো বলেন, ‘ছেলে–মেয়ে, স্ত্রী—যাদের জন্য যা–ই কিছু আমরা করি। আমরা সব কিছু করি সন্তান এবং ফ্যামিলির জন্য। আপনি যদি এক শ টাকা ইনকাম করেন, আয় করেন; তার টোয়েন্টি পারসেন্ট টাকাও আপনি নিজের জন্য ব্যয় করেন না। যদি টোয়েন্টি পারসেন্ট টাকা আপনি নিজের জন্য ব্যয় করেন, তাহলে ৮০ পারসেন্ট টাকা আপনার ফ্যামিলির জন্য ব্যয় হয়। একা থাকা যে কী কষ্ট, তা যারা একা থাকেন তারাই জানেন। আমার আর পৃথিবীর প্রতি, পৃথিবীর মানুষের জন্য কোনো ভালোবাসা নেই। কারণ যাদের জন্য আমি বেশি করেছি, তাদের কাছ থেকেই আমি প্রতারিত হয়েছি। আমার এক বন্ধু ছিল বাবুল, যাকে আমি নিজে না খেয়ে খাইয়েছি। সে আমার প্রায় ২৩ থেকে ২৫ লাখ টাকা মেরে দিয়েছে। এভাবে আমি বিভিন্ন মানুষের কাছে ৫ কোটি ২০ লাখ টাকার মতো পাই। সবশেষ আমি নোবেল নামে একজনকে বিশ্বাস করি। যাকে আমি মিনারেল ওয়াটার প্ল্যান্টের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু দুই বছরেও সেই প্ল্যান্টের যন্ত্র সে কেনেনি। পরে তার কাছে টাকা ফেরত চাইলে, ঝগড়া হয়। এরপর সে দুই দফায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দেয়। বাকি টাকা সে আমাকে দিচ্ছে না। মানুষ কেন এতো লোভী হয়?’

‘পিতামাতা যা উপার্জন করে তার সিংহভাগ সন্তানদের পেছনে খরচ করে। প্রকৃত বাবারা না খেয়েও সন্তানদের খাওয়ানোর চেষ্টা করে, ফ্যামেলিকে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফ্যামেলি অনেক সময় বুঝতে চায় না। নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারলাম না। যারা দেখছেন, তাদের সাথে এটাই শেষ দেখা। সবাই ভালো থাকবেন’।

আসলে একটা মানুষ যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তার নিজের ভিতরে অজান্তেই কিছু জিনিস দানা বেধে ওঠে। যেমন- শারীরিক অসামর্থ্য, অসহায়ত্ব, পরনির্ভরশীলতা, অদৃষ্টের উপর সমর্পণতা ও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা। এগুলোর কারণে মানসিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে নিজেকে অবাঞ্ছিত, পরিবারের বা সমাজের বোঝা মনে করেন। অনেক প্রবীণই বিষণ্ণতায় ভোগেন। অনেক সময় এমন অযৌক্তিক ও শিশুসুলভ আচরণ তাদের মধ্যে প্রকাশ পায়, যাকে অনেকেই ‘দ্বিতীয় শৈশব’ বলে মনে করেন। প্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রবীণরা যৌবনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পরিবারের সদস্যদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করেছেন। জীবনের এ পর্যায়ে এসে তারা অবহেলিত হবেন, এটা কি মেনে নেয়া যায়!

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখের বেশি প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন রয়েছেন। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণদের সংখ্যা হবে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি প্রবীণ জনগোষ্ঠী হবে। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনে একজন প্রবীণ হবেন, যা ওই সময়ের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। বাংলাদেশে আগামী ২০৫০ সালে শিশুর চেয়ে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা এক শতাংশ বেশি হবে। ওই সময় শিশুর সংখ্যা হবে ১৯ শতাংশ এবং প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা হবে ২০ শতাংশ। 

ব্রিটিশ সরকার এ উপমহাদেশে ১৯২৫ সালে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন চালু করে। প্রায় ৭২ বছর পর ১৯৯৭ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার বয়স্কভাতা চালু করে। প্রথম পর্যায়ে ৫০ কোটি, ২০১৪ সালে ১৩০৬ কোটি, পরবর্তী বছরে ১৪৪০ কোটি, ২০১৯-২০ বাজেটে ২৬৪০ কোটি, ২০২০-২১ বাজেটে ২৯৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৮৪ লাখ প্রবীণকে ৫০০ টাকা হারে এ ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু ভাতা দেয়া হচ্ছে মাত্র ৮৪ লাখ প্রবীণকে। ৬৬ লাখেরও বেশি প্রবীণ এ বয়স্ক ভাতার আওতায় নেই। বৃদ্ধ বয়সে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগের ওষুধ ও চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। ভাবুন তো, দুর্মূল্যের এ বাজারে মাত্র ৫০০ টাকায় কী পাওয়া যায়?

কিছুদিন আগে ৯৩ বছর বয়সে এক আইনজীবি একাকীত্ব কাটাতে বিয়ের পিড়িতে বসায়, আমাদের সমাজের কিছু অংশ তাকে নিয়ে উপহাস করতে শুরু করে। কিন্তু আজ যখন ব্যবসায়ী মহসিন আত্মহত্যা করলো, তখন সুশীল জনগণ তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। কেন এই সামাজিক বৈষম্যতা! 

বৃদ্ধ বাবা-মাকে যারা বৃদ্ধাশ্রমে রেখেই ভাবছেন, তাদের দায়িত্ব শেষ। তাদের মনে কি একবারের মতো প্রশ্ন জাগেনি যে, অবহেলিত এই সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য মানসিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিৎ। হয়ত আজ সেই সন্তানেরাই ব্যবসায়ী মহসিনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন। মুখোশের ভিতর মুখ লুকিয়ে রেখে কি দায়বদ্ধতা এড়িয়ে রাখা যায়!

লেখক, সাংবাদিক।