বৃহস্পতিবার ০৮ জুন ২০২৩

| ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
০৯:৩৩, ১২ আগস্ট ২০২১

দ্রোহীকবি হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুদিবস আজ

প্রকাশের সময়: ০৯:৩৩, ১২ আগস্ট ২০২১

দ্রোহীকবি হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুদিবস আজ

দ্রোহী কবি হুমায়ুন আজাদ (Humayun Azad)

কামরুল হাসান বাদল » 

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘যেমনি বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল।’ বাংলাদেশের সমাজ যখন ক্রমশ বুনো হয়ে উঠছিল তিনি তখন বাঘা তেঁতুলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাই তাঁর সে অবস্থান, মতামত, মন্তব্য ও লেখালেখিকে আপোষবাদীরা ঔদ্ধত্য, অশালীন বলেছেন আর তারুণ্যদীপ্ত অনাপোষকারীরা সাহসী, দুর্বিনীত ও প্রথাবিরোধী বলেছেন।

আজ সে বহুমাত্রিক ও প্রথাবিরোধী সাহসী লেখক হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুবার্ষিকী। মূর্খতা, ভণ্ডামী, আপোষহীনতা, ধূর্ততা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরাসরি বলতে গিয়ে, সত্য কথাটি অকপটে বলতে গিয়ে, মৌলবাদকে সরাসরি আক্রমণ করে লিখতে গিয়ে তিনি এইসব অপশক্তির শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। তাদের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আক্রমণের শিকার হতে পারেন জেনেও তিনি ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ এর মতো গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যেখানে তিনি এই অপশক্তিকে সরাসরি আঘাত করেছিলেন। এছাড়া ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ (ফেব্রুয়ারি ২০০৩) ‘ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য’ (ফেব্রুয়ারি ২০০৪) ‘সাম্প্রদায়িকতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’। গদ্যগ্রন্থ ও ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন।

নিজে পুরুষ হয়েও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘নারী’র (১৯৯২) মতো এক অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যা তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। তাঁর অসাধারণ প্রবচনগুচ্ছ বর্তমান সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক শব্দবিপ্লব। সমাজের কপটতা, ধূর্ততা ও শঠতাকে তিনি তাঁর প্রবচনের মাধ্যমে চিত্রণের পাশাপাশি তির্যক আক্রমণও করেছেন। তাঁর একটি অসাধারণ প্রবচন, ‘মানুষ সিংহের প্রশংসা করে কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে’। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় এর চেয়ে সত্য কথা কেউ এমন অকপটে বলেননি।

১৯৮৫ সাল। দেশে তখন জেনারেল এরশাদের স্বৈরতন্ত্র চলছে। সে বছর এপ্রিলে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’। আজ থেকে আটাশ বছর আগে বাংলাদেশকে নিয়ে যে সংশয় তিনি প্রকাশ করেছিলেন আমরা গভীর বিস্ময়ের সাথে তার সত্যতা দেখতে পাই। বুঝতে পারি হুমায়ুন আজাদের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আর নিজের দেশ ও কালকে বুঝে ওঠার, তুলে ধরার নিপুণ অকপটতাকে।

তিনি ছিলেন তাঁর সময়ে কিংবা সব সময়ের এক সাহসী সন্তান। তাই তাঁর চিন্তা ছিল মুক্ত ও স্বাধীন। কাউকে তুষ্ট করতে শেখেননি তিনি এবং সচেতনভাবে তা করতেও চাননি। যে কারণে তিনি যে শুধু ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দ্বারাই সবসময় আক্রান্ত হয়েছেন তা নয়, তিনি তাঁর সহকর্মী, সহলেখক ও নিজের মানুষেরও বিরাগভাজন হয়েছিলেন। যাঁরা সরাসরি সত্য শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন না।

বহুমাত্রিক লেখক ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং কলাম লেখক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০ এরও বেশি। তাঁর ১০টি কবিতার বই, ১৩টি উপন্যাস, ৮টি কিশোর সাহিত্য, ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ আছে। তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্যে তিনি লাভ করেছিলেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৬), অগ্রণী শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার (২০০৪) ও মরণোত্তর একুশে পদক (২০১২)। তাঁর সম্পাদনায় বেশকিছু গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে।

মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে খুব কঠিন ভাষায় আক্রমণ করলেও তাঁর হাতে রচিত হয়েছে ‘আব্বুকে ভালোবাসি’র মতো লেখা। শিশু-কিশোরদের জন্যে তাঁর লেখা ‘লাল-নীল-দীপাবলী’ ও ‘কত নদী সরোবর’ এমন দুটি বই যা পাঠ করে একজন কিশোর শুধু নয়, যে কেউ বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে একটি ধারণা লাভ করতে পারেন। যে হাতে তিনি পাক সার জমিন সাদ বাদ এর মতো বই লিখেছেন সে হাতে তিনি শিশু-কিশোরদের জন্যে অত্যন্ত কোমল ও আবেগময় ভাষায় ‘শুভেচ্ছা’র মতো কবিতাও লিখেছেন-

ভালো থেকো ফুল মিষ্টি বকুল

ভালো থেকো

ভালো থেকো ধান ভাটিয়ালি গান

ভালো থেকো

ভালো থেকো মেঘ মিটিমিটি তারা

ভালো থেকো পাখি সবুজ পাতারা…।

এই দুর্বিনীত ভয়হীন মানুষটি আজ আমাদের মাঝে নেই। এই আপোষকামীতার যুগে, মানিয়ে চলার যুগে, তোষামোদ ও সুবিধাবাদীতার যুগে তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রম পুরুষ। তরুণরা যার ভেতরে আবিষ্কার করতেন বিদ্রোহ ও বিক্ষোভের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

তিনি লিখেছিলেন- ‘এইসব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র-

শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের সুর

গদ্যপদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স লেলিন,

আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা

রাহুগ্রস্ত সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক

আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।’

তারপরেও আজ তাঁর প্রয়াণদিনে আমরা তাঁর ভাষাতেই প্রার্থনা করবো- 'ভালো থেকো ফুল মিষ্টি বকুল-ভালো থেকো…।'

লেখক : কবি ও সাংবাদিক