
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
কামরুল হাসান বাদল
বাঙালি জাতির প্রথম সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করার মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয় চার মূল নীতিমালার ভিত্তিতে। তা হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে প্রথম যে ভাষণ প্রদান করেন সেখানে তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমার রাষ্ট্রে এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এ বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র। এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।'
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আর এই চার মূলনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়নি। সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্তর্ভুক্ত করে বঙ্গবন্ধু তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। অন্তত এ দুই মূলনীতি গ্রহণের কারণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং আমেরিকার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, প্রপাগান্ডা ও ষড়যন্ত্র শুরু করে।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিটি প্রচার করতে থাকে, ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কোরান ও সুন্নাহ বিরোধী আইন পাস করবে না বলে ওয়াদা করেছিল। কিন্তু ভারতের চাপের মুখে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করেছে। এটি যে অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয় তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বরং ইসলামের শাশ্বত সমাজ ব্যবস্থারই রূপ।
আমি এর সপক্ষে রাসুল (সা.) এর একটি হাদিসের বয়ান দিচ্ছি। এ হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘যে তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে (নিজে) খায়, সে আমার উম্মত নহে।’
প্রিয় পাঠক, এবার আসুন এই বিখ্যাত হাদিসটির মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করি। এই হাদিসটি যখন বর্ণিত হয়েছিল তখন আরবের ঘরে ঘরে মুসলিম ছিল না। বরং সে সময় আরবে মুসলিমরাই ছিল সংখ্যালঘু। অর্থাৎ একটি মুসলিম পরিবারের আশেপাশেই ছিল হয়ত কোনো অমুসলিম প্রতিবেশী। সে ধরনের একটি পরিস্থিতিতে নবীজি (সা.) এ হাদিসে শুধু ‘প্রতিবেশী’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন, বলেননি কোনো ‘মুসলিম প্রতিবেশীকে'। তার মানে তিনি প্রতিবেশীদের ধর্মের মাধ্যমে বিভাজিত করেননি। প্রতিবেশী একজন মানুষ সেই চেতনার কথাই বলেছেন। এটি তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল উদাহরণ। আগে মানুষ, তারপরে ধর্ম- এটিই তাঁর আদর্শ হিসেবে পাই। মহানবী (সা.) মদিনার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অমুসলিমদের সাথে চার্টার অব মদিনা প্রণয়ন করেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে।
এখানে উল্লেখ করতে চাই, পশ্চিমারা সেক্যুলার শব্দটি যেভাবে ব্যাখ্যা করেন, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সেরূপ নয়। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। রাষ্ট্র সকল ধর্মের প্রতি, সকল ধর্মের অনুসারীদের প্রতি একই ধরনের আচরণ করবে এবং রাষ্ট্রে সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার থাকবে-অন্তত বাংলাদেশের ব্যাখ্যা ও বাস্তবতায় তাই-ই। এ হাদিস পালন করতে গেলে সমাজে কোনো লোক না খেয়ে থাকবে না। কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না। কেউ অর্থবিত্ত দিয়ে ভোগের সাম্রাজ্য গড়ে তুলবে আর অন্যদিকে মানুষ ভুখা-নাঙ্গা থাকবে- তা রাসুল (সা.) এর হাদিস মতে অনুমোদন যোগ্য নয়। সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টনই হলো তাঁর হাদিসের মর্মকথা।
যারা এতকাল বলে এসেছেন যে বঙ্গবন্ধু ভারতের চাপে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু চিন্তা-চেতনায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তার প্রমাণ দেখি আমরা ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর ভূমিকায়। নিজের জীবন বাজি রেখে রক্ষা করেছেন হিন্দু-মুসলিম উভয়পক্ষকে। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের রক্ষা ও পুনর্বাসনের জন্যে তিনি বিহারে পর্যন্ত গিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান হয়ে।
বঙ্গবন্ধুর উদার ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির চমৎকার উদাহারণ পাই সদ্য প্রকাশিত তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর আবার একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে।
জেল স্মৃতি নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা যখন জেলে তখন এক রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হল, কলকাতা ও ঢাকায়। কলকাতায় নিরপরাধ মুসলমান এবং ঢাকা ও বরিশালে নিরপরাধ হিন্দু মারা গেল।’ দাঙ্গার অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া বন্দিদের বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘তাদের কাছে বসে বলি, দাঙ্গা করা উচিত না। যে কোন দোষ করে না, তাকে হত্যা করা পাপ। মুসলমানরা কোন নিরপরাধীকে অত্যাচার করতে পারে না, আল্লাহ ও রাসূল নিষেধ করে দিয়েছেন। হিন্দুদেরও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তারাও মানুষ। হিন্দুস্থানের হিন্দুরা অন্যায় করবে বলে আমরাও অন্যায় করবো-এটা হতে পারে না। ঢাকার অনেক নামকরা গুন্ডা প্রকৃতির লোকদের সাথে আলাপ হল, তারা অনেকেই আমাকে কথা দিল, আর কোনদিন দাঙ্গা করবে না।’ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের চেহারা তিনি দেখেছেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অমানবিকতা ও হিংস্রতা তিনি দেখেছেন। কাজেই পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে আরেকটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই আসে না তাঁর কাছে।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর উস্কানিতে আহমদীয়াবিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘খাজা (নাজিমুদ্দিন) সাহবের আমলে পাঞ্জাবে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হল। তাতে হাজার হাজার লোক মারা যায়। লাহোরে মার্শাল ল জারি করা হয়। আহমদীয়া বা কাদিয়ানীবিরোধী আন্দোলন থেকেই এই দাঙ্গা শুরু হয়। কয়েকজন বিখ্যাত আলেম এতে উস্কানি দিয়েছিলেন। ‘কাদিয়ানীরা মুসলমান না’-এটাই হল এই সকল আলেমদের প্রচার। আমার এ সম্বন্ধে কোন ধারণা নাই। তবে একমত না হওয়ার জন্য যে অন্যকে হত্যা করা হবে, এটা যে ইসলাম পছন্দ করে না এবং একে অন্যায় মনে করা হয়-এটুকু ধারণা আমার আছে। কাদিয়ানীরাতো আল্লাহ ও রাসুলকে মানে, তাই তাদেরতো কথাই না। এমনকি বিধর্মীদের উপরও অন্যায়ভাবে অত্যাচার করা ইসলামে কড়াভাবে নিষেধ আছে। লাহোরে ও অন্যান্য জায়গায় জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে স্বামী, স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে একসাথে ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। যারা এই সমস্ত জঘন্য দাঙ্গার উস্কানি দিয়েছিল তারা আজও পাকিস্তানের রাজনীতিতে সশরীরে প্রতিষ্ঠিত আছে।’
সমাজতন্ত্রের বিষয়েও বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত আকস্মিক ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই তিনি আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন, ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে- তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্ব শান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’
এরপরে আশা করি আর প্রশ্ন করার অবকাশ থাকে না। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল পরিষ্কার। সংবিধানে মূলনীতি করার পিছনে তাঁর যৌক্তিক অবস্থান ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য পরবর্তীতে বাকশালের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েই তিনি নিন্দিত হলেন। কিন্তু বাকশালের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা, গবেষণা কিছুই হলো না দেশে। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা, আওয়ামী ঘরানার কোনো বুদ্ধিজীবী, এমনকি বাকশালের অন্যতম শরিক কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, যাঁরা সমাজতন্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা- তাঁরাও কোনোদিন এ বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেননি। জাতির সামনে বঙ্গবন্ধুর এই মহান কর্মসূচির কিছুই উপস্থাপিত হলো না। কিন্তু বাস্তবতা হল- বাকশালের গ্রাম সমবায় বা স্থানীয় সরকার পদ্ধতিসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে অনেক আগেই সমৃদ্ধ একটি দেশে পরিণত হতো বাংলাদেশ।
আজ বিশ্বব্যাপী মানবতার লাঞ্ছনা দেখে, মৌলবাদ, বর্ণবাদের উত্থান দেখে, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আকাশচুম্বি ব্যবধান দেখে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও চিন্তাধারার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি প্রতিনিয়ত।