সোমবার ০৫ জুন ২০২৩

| ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
১৩:৪০, ২২ জানুয়ারি ২০২২

কামরুল হাসান বাদল

গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অনভিপ্রেত ও বাস্তবতাবিবর্জিত

প্রকাশের সময়: ১৩:৪০, ২২ জানুয়ারি ২০২২

কামরুল হাসান বাদল

গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অনভিপ্রেত ও বাস্তবতাবিবর্জিত

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল দুই মাস আগে। এর ফলে সমাজ ও অর্থনীতিতে এর যে প্রভাব পড়েছে তা কাটাতে না কাটাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। এ মাসের শুরুতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি বিভাগ। 

৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানায় তারা। এরপর ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি অভিন্ন প্রস্তাব তৈরি করে। আবাসিকে দুই চুলায় ৯৭৫ থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ১০০ টাকা ও এক চুলায় ৯২৫ থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করতে চায় তারা। আবাসিকে প্রিপেইড মিটার, শিল্প-কারখানা, সিএনজি, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ক্যাপটিভে (শিল্পকারখানায় নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুৎ) ব্যবহৃত গ্যাসের দামও দ্বিগুণের বেশি করার প্রস্তাব করা হয়। তবে তাদের সে প্রস্তাব বিধিসম্মত না হওয়ায় ফিরিয়ে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

বিইআরসির দুজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদপত্র এই খবর ছাপিয়েছে। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সম্ভবত তাঁদের আপত্তি নেই। তাঁরা বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করতে হলে প্রবিধানমালা মেনে প্রস্তাব জমা দিতে হবে। বিতরণ কোম্পানি তা মানেনি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ প্রয়োজনীয় নথি জমা দেয়নি। তাই তাদের নিয়ম মেনে আবেদন করতে বলা হয়েছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত বৈধ কোনো আবেদন জমা পড়েনি। মনে হচ্ছে কথিত ‘প্রবিধান’ মেনে আবেদন করা হলে বিইআরসি দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়ে নিতে পারে।

বিইআরসির সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে এখন দিনে গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে ২৩০ কোটি ঘনফুটের (৭৮ শতাংশ) বেশি আসে দেশের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে। আর কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি হয় মোট সরবরাহের ১৭ শতাংশ। আর ৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক খোলাবাজার থেকে কেনা হয়। এখন এই ৫ শতাংশ গ্যাসের বাড়তি দামের নামে গ্যাসের দাম দ্বিগুণেও বেশি করার প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো।

পেট্রোবাংলা গণমাধ্যমকে বলছে, গত মাস থেকেই দেশে গ্যাস সরবরাহে সংকট শুরু হয়েছে। আগামী এক মাসেও সংকট কাটার সম্ভাবনা নেই। বাসায় চুলা জ্বলছে না। শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসের অভাবে। মহেশখালীতে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটি বন্ধ হয়ে আছে। বাকি একটি দিয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না।

বিইআরসির চেয়ারম্যান পত্রিকাকে বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া হয়নি, মূল্যবৃদ্ধির আবেদনও যথাযথ হয়নি। প্রবিধানমালা মেনে প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। প্রস্তাব জমার পর তা যাচাই-বাছাই করে কমিশনের কারিগরি কমিটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেবে। এরপর তা আমলে নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।

কমিশন আমলে নিলে প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি হবে। এরপর দাম বাড়ানো বা না বাড়ানোর বিষয়ে কমিশন আদেশ দেবে। এর আগে ২০০৮ সালে বিতরণ কোম্পানির দেওয়া ৬৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল কমিশন। ২০১৯ সালে শেষবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের মতে, দেশে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট (হাজার ঘনমিটার) গ্যাসে পেট্রোবাংলার খরচ দুই টাকার কিছু বেশি। আর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আনতে এখন ইউনিটপ্রতি খরচ পড়ছে ৩৮ টাকা। বর্তমান দামে খোলাবাজার থেকে আমদানি করতে হলে ইউনিটে খরচ হবে ৮৫ টাকা। এ হিসেবে গড়ে ইউনিটপ্রতি খরচ ধরে দাম দ্বিগুণ করতে চায় বিতরণ কোম্পানি।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, বিশ্ববাজার থেকে এখন এলএনজি আমদানি খরচ ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা । এতে সব মিলে পেট্রোবাংলার প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহের গড় খরচ পড়বে ২১ টাকা। আর বর্তমানে গ্রাহকের কাছে গ্যাস বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৯ টাকা ৩৭ পয়সায়।

অন্যদিকে পেট্রোবাংলা বলছে, বিতরণ কোম্পানি গ্যাস বিক্রির কমিশন পায়। তাদের তো লোকসানের কিছু নেই। কিন্তু গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে গিয়ে লাভ-লোকসানের হিসাব করতে হয় পেট্রোবাংলাকে। বিতরণ কোম্পানি গ্যাস বিক্রি করে বাড়তি আয় করতে না পারলে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি আনতে হয় পেট্রোবাংলাকে। 

জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, গত অর্থবছরেও সরকারি তহবিলে কয়েকশ’ কোটি টাকা জমা দিয়েছে পেট্রোবাংলা। সরকারি ছয় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস, কর্ণফুলী, জালালাবাদ, বাখরাবাদ, সুন্দরবন ও পশ্চিমাঞ্চল মুনাফা করেছে সর্বশেষ বছরেও। একইভাবে মুনাফা করেছে সরকারি গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএল।

বিইআরসি’র দু’জন শীর্ষ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, মূল্যবৃদ্ধির এই প্রস্তাবকে তারাও অযৌক্তিক ও অবাস্তব বলে মনে করছেন। করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দার সময় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো হবে। এ সময়ে ৯৭৫ টাকার গ্যাস বার্নারের খরচ ২১০০ টাকা করার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি গ্যাসের দাম বা দেশের গ্যাস সরবরাহ কোম্পানিগুলোর পরিচালন খরচ বাড়েও তাতেও তা ১৫ থেকে ২০ ভাগের বেশি হতে পারে না।

বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও মাত্র ৫ ভাগ গ্যাস খোলা বাজার থেকে কেনার অজুহাতে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধির প্রস্তাব অনভিপ্রেত, বাস্তবতাবিবর্জিত ও কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের ব্যয় বাড়বে, শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, পরিবহন ব্যয় বাড়বে এবং এর ফলে আরেক দফা জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। অর্থাৎ সমাজের সব স্তরেই এই মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে।

করোনার অমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণে মানুষের জীবন আবার চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে যাচ্ছে। দীর্ঘ দুই বছর ধরে মহামারীর সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত, শ্রান্ত, নিঃস্ব সাধারণ মানুষকে এই সময়ে অন্তত এই চাপটা না দিলেই কি নয়? এমনিতেই সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। প্রতিদিন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে ন্যায্যমূলের পণ্যের ট্রাকের সামনের লাইন। লাফ দিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ, ক্রমাগত বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল এর মধ্যে গ্যাসের মতো একটি পণ্যের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যারা নিতে পারে তাদের বাস্তব জ্ঞান আছে কি না, তারা সাধারণ মানুষের খবর রাখে কি না, তারা সড়কে যাতায়াতের সময় টিনের চশমা পরে থাকেন কি না তা জানতে ইচ্ছে করছে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক