সোমবার ০২ অক্টোবর ২০২৩

| ১৬ আশ্বিন ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
০৮:৫০, ১৮ নভেম্বর ২০২১

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম

দেড়যুগেও কিনারা হয়নি শীলপাড়ার ১১ হত্যার

প্রকাশের সময়: ০৮:৫০, ১৮ নভেম্বর ২০২১

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম

দেড়যুগেও কিনারা হয়নি শীলপাড়ার ১১ হত্যার

আজ ১৮ নভেম্বর। ২০০৩ সালের এই দিনে বাঁশখালী সাধনপুরের শীলপাড়ায় ১১ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ৪ দিনের একটি শিশুসহ এই নির্মম হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর সকল সভ্যতার ইতিহাসকে হার মানিয়েছে। কার্তিক মাসে জন্ম হয়েছিল বলে মা-বাবা শিশুটির নাম রেখেছিল কার্তিক। গর্ভধারিণী মা শিশু সন্তানটিকে বাঁচানোর জন্য ঘরে থাকা আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছিল যাতে শিশুটির প্রাণ রক্ষা হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না তার। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল মা-ছেলে দু’জনই।

পবিত্র রমজান মাসের শবে কদরের রাত। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইবাদত বন্দেগিতে ব্যস্ত ছিল। সেহেরির সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। এমন সময় বাণীগ্রামের প্রেমানন্দ চৌধুরী আমাকে ফোনে বললেন, সাধনপুরের শীলপাড়ায় ১১ জনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা। আমি ফজরের নামাজ পড়ে বাঁশখালীর উদ্দেশে রওনা দিলাম। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। সবাই বলাবলি করছে, এটি একটি ডাকাতির ঘটনা। আমি তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করলাম। ডাকাতির ঘটনাই যদি হবে তাহলে গান পাউডার নিয়ে আসল কেন? এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। জমি-জমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ঘটনাটি ঘটেছিল বলে আমার ধারণা। ওইদিন আমাদের দলীয় নেতাকর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। সুলতান উল কবির চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

২০০১ সালে ১ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনের দীর্ঘ ২৬ মাস পর অর্থাৎ ঘটনার কিছুদিন পর সুলতান ভাই এলাকায় আসেন। ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের একটি সংসদীয় কমিটি তদন্তে আসেন। বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপির নেতৃত্বে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে তার সাথে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মির্জা আজম এমপি, রফিকুল আনোয়ার এমপি (প্রয়াত), ফজলে করিম এমপি, তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী নেতা,  বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি। আমি, সাইফুউদ্দিন রবি, আব্দুল্লাহ কবির লিটন, আবু সৈয়দ, রণতোষ দাশ, নূর হোসাইন, সাধনপুরের বর্তমান চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খোকা, তৎকালীন চেয়ারম্যান আহসান উল্লাহ চৌধুরীসহ অনেকেই ঘটনাস্থলে ছিলাম। এর কয়েকদিন পর সাবেক চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আলহাজ এ. বি. এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন।

বিএনপির নেতা জাফরুল ইসলাম চৌধুরী তখন জোট সরকারের বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী। তিনি ঘটনাস্থলে মহিউদ্দিন ভাইকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে এটি একটি নিছক ডাকাতির ঘটনা। মহিউদ্দিন ভাই তাকে ধমক দিয়ে কথা বলেছিলেন। ঢাকা থেকে ঘোষণা আসল শীলপাড়ার ১১ হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমাবেশ করবে। আমরা সবাই জেলা-উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এরই মাঝে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সার, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আলহাজ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, সাধারণ সম্পাদক মোছলেম উদ্দিন আহমদ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এম এ মান্নানসহ উত্তর-দক্ষিণ, মহানগর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ২ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কালীপুর স্কুলের মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিবাদ সমাবেশে নেত্রী ঘোষণা দিলেন এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আসল খুনিদের বের করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হবে। নেত্রীর সাথে সেদিন আমরাও ছিলাম। 
চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল বলে সেদিন খুনিরা পার পেয়ে যায়। তৎকালীন জোট সরকারের মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর চাচাত ভাই এলাকার চেয়ারম্যান আমিনুর রহমানকে মামলায় আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার ছিল ক্ষমতার দাপটে। বাদিপক্ষকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বারবার হুমকি দিয়ে আসছিল আসামিপক্ষ। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে হত্যা মামলায় কিছুটা প্রাণ ফিরে আসে। জামিনে এসে মামলার অন্যতম আসামি আমিনুর রহমান সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে মামলার স্থগিতাদেশ চেয়ে একটি রিট আবেদন করেন। এতে মামলা ঝুলে যায়। এর কিছুদিন পর স্থগিত আদেশ খারিজ হয়ে মামলা পুনরায় চালু হয়। ইতোমধ্যে ২১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।

দীর্ঘ ১৮ বছর অতিবাহিত হলো। তারপর আর কোনো বিচারিক কার্যক্রমের অগ্রগতি হয়নি। বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে। সকল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র বা সরকার । মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা যাবে না। ১১ জন মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো। সেই খুনিদের খুঁজে বের না করে চারদলীয় জোট সরকার বিষয়টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করল। যা জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখ এবং লজ্জাজনক ঘটনা।

’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনি মোশতাক ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিল। যে কোনো হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নপথে পরিচালিত করা বিএনপি, জামাতের স্বভাবজাত  ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে এ দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর জুলুম, নির্যাতন ও অত্যাচার চালিয়েছিল তারা। তাদের অপরাধ ছিল তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যাকারী জামাত-বিএনপি এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ভুল পথে পরিচালিত করেছে।

এ দেশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মানুষ হিসেবে সকলে আমরা ভাই ভাই। আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য। যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সকলকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কোনো মানুষ যেন অন্যায়ভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার না হয়। শীলপাড়ার ১১ হত্যাকাণ্ডের মামলাটি অতি দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কমে যাবে।

লেখক : শ্রমবিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ