
শেখ রাসেল (Sheikh Russel)
কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো এ দেশের মানুষ কখনোই পাবে না। তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি হলো- অবুঝ শিশু বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলের হত্যা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপরে হয়ত খুনিচক্রের ক্ষোভ থাকতে পারে, কেন না তিনি এদেশের মানুষকে মুক্ত করেছেন, এই দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। কিন্তু ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল, তাঁর কি অপরাধ থাকতে পারে! অদ্ভুত মায়াবী নিষ্পাপ এক চেহারার রাসেল। ছোট্ট শিশুর মনের অবস্থা সেদিন কী হয়েছিল! আর যে পাষণ্ডরা তাঁর বুকে গুলি চালালো, কীভাবে পারলো তারা। একটুও কি হাত কাঁপেনি তাদের? একটু বুক কাঁপেনি? খুনিদের নিজেদের তো পরিবার-পরিজন শিশুসন্তান ছিল। পঁচাত্তরের পনের আগস্টের নির্মমতা ছাড় দেয়নি ছোট্ট রাসেলকেও। তখন সে বারবারই বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাবো’। মায়ের কাছে যাবার নাম করে, মা-বাবা, পরিবারের সকলের লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নেওয়া হল তাঁকে। অতঃপর নিভিয়ে দেয়া হল সেই প্রদীপ, যে প্রদীপ একদিন বাংলাদেশকে আলোকিত করত। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানিতে ছিলেন। শেখ হাসিনা জার্মানি যাওয়ার সময় আদরের ভাই রাসেলকে সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁর জন্ডিস হওয়ায় মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তাকে বিদেশে যেতে দেননি। এই আফসোসটা হয়তো বড় বোন শেখ হাসিনার চিরকালই রয়ে যাবে। সেদিন যদি তিনি রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন, তাহলে তাকে হারাতে হতো না।
১৮ অক্টোবর সাল ১৯৬৪। শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলতুন্নেসা মুজিবের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক পুত্রসন্তান। শেখ রাসেলের জন্মের পর গোটা পরিবারে যেন আনন্দের ঝড় নামে। সেদিন বঙ্গবন্ধু ছিলেন চট্টগ্রামে। রাসেলের জন্মটি পরিবারের সকলের কাছে ভিন্ন আনন্দের মাত্রা প্রদান করে। ‘রাসেল হওয়ার পরে আমরা ভাই-বোনেরা খুব খুশি হই। যেন খেলার পুতুল পেলাম হাতে। ও খুব আদরের ছিল আমাদের। একটা ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলত। ওইটুকু একটা মানুষ, খুব স্ট্রং পার্সোনালিটি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিজীবনের অজানা-অদেখা গল্প নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘হাসিনা: অ্যা ডটারস টেল’-এ বঙ্গবন্ধুকন্যা এভাবেই তুলে ধরেন ছোট্ট রাসেলকে।
‘রাসেল’ নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন এই পৃথিবীটাকে মানুষের বসবাসের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় করার লক্ষ্যে নিরুলস কাজ করে যাওয়া বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবী বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি সর্বকনিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখলেন শেখ রাসেল। রাসেলের নামকরণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অনেক বছর পর একটা ছোট্ট বাচ্চা আমাদের বাসায় ঘর আলো করে এসেছে, আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। আব্বা বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে বাংলায় ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে নিজের ছোট সন্তানের নাম রাসেল রাখেন।’
রাসেলের জন্ম নিয়ে আরেক বড় বোন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘মা বলতেন, লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থেক, তাহলে তোমাকে একটা ছোট্ট বাবু এনে দেব। মার কথামতো লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকার চেষ্টা করতাম। গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম কখন মা আমাকে একটা বাবু এনে দেবে। রাসেলের জন্ম হয় অনেক রাতে। আমি ঘুমিয়েছিলাম। আমার মেজফুফু ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, জলদি ওঠ, তোমার ভাই হয়েছে। জন্মের পরে ওকে আমার মনে হয়েছিল একটা পুতুল। কী সুন্দর হাসে, আবার কাঁদেও। রাসেল একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠে। মা ও আব্বা নাম রাখলেন রাসেল। স্কুলের নাম ছিল শেখ রিসালউদ্দীন। হাসু আপা ওকে কোলে করে কত গান শোনাত, কত কবিতা শোনাত। কামাল ভাই আর জামাল ভাইও কোলে নিত। আমিও নিতাম। ভয়ও করতাম, যদি পড়ে যায়! যদি ব্যথা পায়! ওর খুব কষ্ট হবে।”
বাবা ছিলেন এই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, এই বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাঁসি ফোটাতে যিনি নিজের জীবন যৌবনকে তুচ্ছ করেছিলেন। বারবার কারাবরণ করেছেন, পরিবারের প্রতি এই ছিল তাঁর এক অবিচার। নিজ পরিবার-সন্তানদের থেকে বছরের পর বছর দূরে ছিলেন। এ কারণেই বাবাকে খুব বেশি কাছে পায়নি বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান রাসেল। এক ধরনের চাপা কষ্ট পিতা বঙ্গবন্ধু যেমন বয়ে বেড়াতেন, তেমনি ছোট্ট শিশু রাসেলের মনেও একই প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছিল। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অসংখ্যবার ছোট্ট সন্তান প্রিয় রাসেলের কথা তুলে ধরেছেন। অবুঝ ছেলেটিকে সময় দিতে না পারার যন্ত্রনঅ তাঁর বিবেকে দংশন করত। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কি উত্তর ওকে আমি দিব? ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম। ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মা'র বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’
প্রয়াত লেখক, সাংবাদিক, সাংসদ ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বেবি মওদুদের লেখনীতে ফুটে ওঠে শিশু শেখ রাসেলের মনে উঁকি ঝুঁকি করা রাজনৈতিক কৌতূহল। তিনি লিখেছেন, ‘রাসেল একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা আব্বার কাছে যাবে না?’ মা কোনো উত্তর দেন না। শুধু তাকে বুকের কাছে টেনে আদর করেন। রাসেল আবার জিজ্ঞেস করে, ‘মা, আব্বার নাকি ফাঁসি হবে। ফাঁসি কি মা?’ মা বলেন, ‘কে বলেছে তোমাকে এ কথা?’ রাসেল উত্তর দেয়, ‘সেদিন কাকা আর দুলাভাই, কামাল ভাই বলছিল, আমি শুনেছি মা।’ কারাগারে বাবার সাথে সাক্ষাৎকালে রাসেল ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ বলে উচ্ছ্বসিত হতেন।
ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন শেখ রাসেল। চার বছর বয়স হলে তাঁকে স্কুলে দিয়ে আসত পরিবারের কেউ না কেউ। এভাবে স্কুলের প্রতি টান বেড়ে যায় তাঁর। স্কুলে অনেক বন্ধুও হয়েছিল। একদা তাঁর প্রিয় বন্ধুরা শুনতে পায় তাদের সেই বন্ধু রাসেল আর কখনো স্কুলে আসবে না। আর কখনো তাদের সাথে খেলবেনা। শেখ রাসেলের বন্ধু হাফিজুল হক রুবেল এক স্মৃতিকথায় বলেন, শেখ রাসেল ফুটবল খেলতে পছন্দ করতেন। ক্লাসের ফাঁকে বা টিফিনে তারা ফুটবল খেলতেন। খেলার ক্ষেত্রে রাসেলের আগ্রহই ছিল বেশি। তিনি অন্যদের উৎসাহ দিতেন। আর ক্লাসে তার আচরণ ছিল শান্ত। পড়া ধরলে সবার আগে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতেন তিনি। আর উত্তর জানা না থাকলে চুপ করে থাকতেন। রুবেল আরও বলেন, রাসেল পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। ভালো রেজাল্টও করতেন। তখন স্কুলের নিয়ম ছিল রেজাল্ট শিটে অভিভাবকের স্বাক্ষর নিয়ে আবার স্কুলে জমা দেয়া। কিন্তু শেখ রাসেলের রেজাল্ট শিট জমা দিতে মাঝেমধ্যেই দেরি হতো। এজন্য সাধারণত তিন থেকে চারদিন সময় দেওয়া হতো। শিক্ষকেরা রেজাল্ট শিট জমা দিতে দেরির কারণ জানতে চাইলে রাসেল যথাযথ জবাব দিতেন। তার বাবা দেশে না থাকা বা রাষ্ট্রীয় কাজে ঢাকার বাইরে থাকার কারণেই এমন হতো বলে জানাতেন রাসেল।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা তাঁকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তাদের এই ঘৃণ্য অপচেষ্টা শতভাগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। গ্রাম-গঞ্জ-শহর তথা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদ-লোকালয়ে শেখ রাসেল আজ এক মানবিক সত্ত্বা। বাংলাদেশের সকল অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক এবং শিশু-কিশোর, তরুণ, শুভবুদ্ধি বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে ভালবাসা ও আবেগের নাম হয়ে আছেন শহীদ শেখ রাসেল। মানবিক চেতনাসম্পন্ন মানুষরা শেখ রাসেলের বিয়োগ দুঃখ-বেদনাকে হৃদয়ে ধারণ করে বাংলার প্রতিটি শিশু-কিশোর তরুণের মুখে হাসি ফোটাতে আজ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
শিশু রাসেলকে নিয়ে দুই বাংলার প্রখ্যাত কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘শিশুরক্ত’ কবিতায় লিখেছেন-
‘রাসেল, অবোধ শিশু, তোর জন্য
আমিও কেঁদেছি
খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা
একদিন তুলেছিল আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি
তারাই দু’দিন বাদে থুতু দেয়, আগুন ছড়ায়-
বয়স্করা এমনই উন্মাদ।
তুইতো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি!
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো
শিশুরক্তপানে তার গ্লানি নে?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই।’
শেখ রাসেলের মৃত্যু এই জাতিকে আজন্ম অপরাধী করে রাখবে। এই অপরাধের খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে, যেদিন এই দেশের কোনো শিশু অকালে ঝরে পড়বে না। এই দেশ হবে শিশুদের অনুকূলে বাসযোগ্য। জ্ঞানে-শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে এই দেশগড়ার কাজে নিয়োজিত হবে। শেখ রাসেলের মতো আর কোনো ফুল অঙ্কুরেই বিনষ্ট যেন না হয়। প্রস্ফুটিত হোক সকল ফুল, সুবাসিত হোক পৃথিবী।
লেখক : কলামিস্ট, সাবেক ছাত্রনেতা