
সিআরবি
মোহাম্মদ আমানউল্লাহ খান «
আমাদের চট্টগ্রাম শহর সমস্ত বাংলাদেশের মধ্যে প্রাচীনতম শহর এবং দেশের বৃহত্তম বন্দর নগর। এ শহরে একযুগে আরব বণিকেরা এসেছে, অনেকে এই বন্দরকে ভালোবেসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। তাদের পরবর্তী বংশধরেরা এখনো এই দেশে বসবাস করছে। আরবদের পরে এসেছে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা। তাদের অবস্থানের চিহ্নস্বরূপ বিভিন্ন ভবন চট্টগ্রামে কালের স্রোতে যুগযুগ ধরে বেঁচে ছিলো।
আমি মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র। এ স্কুলের সেই প্রাচীন জমকালো ভবনটি এখন আর নেই। এটা ভেঙে যায়নি। ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।
আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র, একদিন ছুটির পরে আমরা কয়জন স্কাউট আমাদের স্কুল পাশ্ববর্তী স্কাউট ডেনে কোনো এক অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় স্কুলের দক্ষিণ পূর্ব দিকের পথ ধরে দুজন বিদেশি পুরুষ এবং একজন বাঙালি নান স্কুল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেন। বুঝতে পারলাম সম্ভবত নানটি তাদের দুজনকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে এসেছেন। সম্ভবত তারা এসেছিলেন নিকটস্থ সেন্ট প্ল্যাসিডস হাই স্কুল থেকে। প্রতিষ্ঠানটির স্কুলের সাথে একটি খ্রিস্টান মিশনারিও ছিলো। সেখানে যারা আসতো মিশনের কাজে বাংলা ভাষা শিখে আসতো।
আমাদের কে দেখে তারা আমাদের দিকে এগিয়ে আসলেন। আসতে আসতে একবার স্কুল ভবন আর একবার স্কুলের উত্তরে মাঠের দিকে বিশাল বৃক্ষরাজীর দিকে বিস্মিত নয়নে বারবার দেখছিলেন। আমাদের কাছে এসে তাদের একজন বললেন, ‘তোমাদের স্কুলটিতো খুবই সুন্দর! আর এই গাছ দুটিও!’। তিনি গাছগুলোর ইংরেজি বা ল্যাটিন নাম বলেছিলেন। নাম গুলো ভুলে গেছি।
সে মাঠের পশ্চিমদিকে ছিলো পাকা উচু টেনিস কোর্ট। স্কুল ভবনের দক্ষিণে ছিলো দর্শনীয় সুন্দর বাগান। এসবের কিছুই এখন আর নেই।
একসময়ের বিদেশিদের মুগ্ধতা জাগানিয়া নয়নসুখকর সেই মুসলিম হাই স্কুলের দিকে এখন আর কেউ ফিরেও দেখেনা!
পর্তুগিজদের নির্মিত আরো ভবন সমুহ হলো চট্টগ্রাম এসপি অফিস, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের মূল ভবন, হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের মূল ভবন। এদের সবকটিকেই ‘আধুনিক’ করা হয়েছে।
এরপরে এলো ব্রিটিশ যুগ। চট্টগ্রামে বৃটিশ যুগের সবচেয়ে দর্শনীয় ভবন ছিলো চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ। এ ভবনের নয়নমুগ্ধকর সৌন্দর্যটাকে বিনষ্ট করা হলো, এখানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর। জিয়াউর রহমানের হত্যাকারীদের কোনো বিচার হলোনা বরং বিচার হলো ভবনটির। তার নয়নমুগ্ধকর নির্মাণশৈলিকে বিকৃত করে রূপান্তরিত করা হলো জিয়া স্মৃতি জাদুঘর হিসাবে। তার সামনে বানানো হলো বিকট দর্শন একটি শিশুপার্ক। এ যেনো এক অবহেলিত রাজরানী, যে ভাগ্যের ফেরে মলিন চাকরানীর বেশে বেঁচে আছে।
এখন ধ্বংসের আয়োজন করা হচ্ছে সিআরবি। নির্মিতব্য প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সর্বসাধারণকে যতই ছেলে ভুলানো ছড়া গাওয়া হোক না কেনো, ৫০০ বেডের হাসপাতাল মানে বর্তমান মেডিকেল কলেজ হসপিটালের সমান । চোখ বুজে একবার কল্পনা করে দেখুন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সমান একটি ভবন এবং তৎ সংলগ্ন অন্যান্য স্থাপনা আর তার পাশে সিআরবি ভবনটি। এ ভবনের সুন্দর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ এবং দৃশ্যপট কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে।
চট্টগ্রামের টিবি হাসপাতাল যদি কুমিরাতে হতে পারে, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল যদি ফৌজদারহাটে হতে পারে তবে এই হাসপাতাল চট্টগ্রামের বুকের ভেতর করার মানে কি? সিআরবি ধ্বংসের কথা যদি বাদও দেই, চট্টগ্রামে ইতিমধ্যে দুঃসহ যানজটে এই স্থাপনার কারণে সংযোজিত ট্রাফিকের চাপের কথা কেও কি ভেবে দেখেছেন? এতো কিছু অনিষ্ঠকর সম্ভাবনার পরেও এই জায়গাটিতেই কেনো হাসপাতাল করা লাগবে ? এমন কি কারণ আছে যা প্রকাশ করা তাদের জন্য সম্ভব না? স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে কোনো এক বা একাধিক ক্ষমতাবান ব্যাক্তির আর্থিক স্বার্থ নিহিত আছে চট্টগ্রামের এই ঐতিহাসিক ভবন এবং চতুর্পাশ্বের মনোরম পরিবেশ ধ্বংস করার হীন প্রচেষ্টায়।
অথচ চট্টগ্রামে এখনো অনেক জায়গা আছে যেখানে এই কথিত প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হতে পারে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ যখন স্থাপিত হয় তখন সেটি মূল শহরের বেশ তফাতে ছিলো, এখন সেটি শহরের ভিতর। এভাবে যদি তুলনা করা যায়, কর্নফুলী টানেল হবার আনোয়ারার দূরত্ব সে হিসেবে খুব বেশি অধিক হবেনা, বর্তমানে যাতায়াত ব্যবস্থাও আগের থেকে অনেক বেশি উন্নত।
চট্টগ্রামের শিক্ষিত এবং সচেতন জনসাধারণের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও এই ধ্বংসাত্বক কর্ম পরিকল্পনার প্রতিবাদ করছি। এমনকি এর গুরুত্ব অনুধাবন করে মাননীয় রেল মন্ত্রী মহোদয় এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসাবে পরিচিত নাগরিক জীবনের ব্যস্ততার মাঝে স্বস্তি লাভের এই অপ্রতুল মাধ্যমটিও যেনো ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে না যায়, এই প্রার্থনা রইলো।