
বিগত সময়ের ধারাবাহিকতায় শুরু হওয়া নতুন বছরেও সড়ক দুর্ঘটনা ক্রমশ ভয়াবহ আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে ঘর থেকে সড়কে পা ফেললেই নিরাপদে ফিরে আসতে পারবে তার যেন নিশ্চয়তাই নেই। সামাজিক নানা শঙ্কা-আশঙ্কার সাথে এ শঙ্কাটিও মানুষের প্রাত্যহিক দুশ্চিন্তার অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ে নানা সংগঠনের বহুমূখী পদক্ষেপের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞগণ থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ সাধারণ লোকজন প্রতিদিন এ বিষয়ে দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। তদুপরিও এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে পরিকল্পনামাফিক ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যকর কোনো আভাস মিলছে না বললেই চলে। এমনকি বিগত সময়ে সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় পরিসরে বেশ কয়েকটি ছাত্র আন্দোলনও আমরা দেখেছি।
সদ্য বিদায়ী বছরের শেষ মাস তথা ডিসেম্বর মাসে সারাদেশ ব্যাপি সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন আমরা সবাই পত্রিকা মারফত জেনেছি। 'রোড সেফটি ফাউন্ডেশন' নামক একটি সংস্থার বরাত দিয়ে এ গবেষণা প্রতিবেদনটি ছাপা হয়। অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণাত্মক এ গবেষণা প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ থেকে যদি কিছু তথ্য তুলে ধরি তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ এক চিত্র আমাদের সামনে উঠে আসবে। এতে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে মোট ৩৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বমোট ৪১৮ জন লোক প্রাণ হারিয়েছেন। তন্মধ্যে ৬৩ জন নারী, ৪৯ জন শিশু এবং বাদবাকিরা পুরুষ। দুর্ঘটনার প্রকৃতি অনুযায়ী এর মধ্যে শুধুমাত্র মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৮ জন। মোট দুর্ঘটনার অনুপাতে যার হার ৪৩.৬০% শতাংশ। বর্ণিত তথানুযায়ী যেটি দেখা যায়, সড়কে সাম্প্রতিক সময়ে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। কারণ দেখা যাচ্ছে এ ধরণের দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্র এবং উঠতি বয়সের তরুণ। যার ফলে দেশ যেমন হারাচ্ছে সম্ভাবনাময় মূল্যবান ভবিষ্যত তেমনি পরিবারও হারাচ্ছে মূল্যবান কিছু জীবন। এমন অবস্থায় সামগ্রিক সচেতনতার পাশাপাশি আমাদের পরিবারগুলোকে আরও অধিকতর সচেতন হওয়া জরুরি। তাদের উচিত আবদার মেটাতে গিয়ে ছেলের হাতে একটা মোটর সাইকেল তুলে না দেই।
এ তো গেলো বিগত বছরের কথা। নতুন আশা নিয়ে আমরা বছর শুরু করি। নানা পরিকল্পনার কথা বলি। নানাক্ষেত্রে নানান সম্ভাবনা ও পদক্ষেপের প্রত্যয় ব্যক্ত করি। অথচ বাস্তবতার দিকে তাকালে তথৈবচঃ।বরং প্রকৃত বাস্তবতা আমাদের আশঙ্কাকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
প্রথম সারির কিছু জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক এবং অনলাইন ওয়েব পোর্টাল থেকে সদ্য শুরু হওয়া বছরের প্রথম সাত দিনের সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ বিশ্লেষণ করে যে তথ্যটা তুলে এনেছি তা দেখলে কারও অনুমান করতে কষ্ট হবে না সড়কে আমাদের আগামীর নিরাপত্তা কতখানি হতে পারে। আমার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ৭ জানুয়ারি এই সাত দিনে সারাদেশে সড়কে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে মোট ৪৩ টি। তাতে প্রাণ হারিয়েছেন সর্বমোট ৬০ জন মানুষ। তন্মধ্যে ৪৮ জন পুরুষ, ৯ জন নারী এবং ৩ জন শিশু। দুর্ঘটনার ধরণ অনুযায়ী বাস-ট্রাক-সিএনজি চালিত অটোরিকশা-ট্রাক্টর-নসিমন অর্থাৎ মোটর সাইকেল ব্যতীত অন্যান্য যন্ত্রচালিত যান দুর্ঘটনা হয়েছে ২১ টি, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা হয়েছে ২৯ টি এবং রাস্তা পারাপার কিংবা গাড়িচাপায় দুর্ঘটনা হয়েছে ১০ টি। সারাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে মোট ২০টি জেলায় এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, যার মধ্যে মহাসড়কে ১৬ টি এবং আঞ্চলিক সড়কে ২৭ টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। জেলাওয়ারি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বরিশাল জেলায় সর্বোচ্চ ৬টি, টাঙ্গাইল জেলায় ৪টি, ঢাকা, বগুড়া, ও লক্ষ্মীপুর জেলায় ৩টি করে, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, দিনাজপুর, যশোর, নারায়ণগঞ্জ, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলায় ২ টি করে এবং সুনামগঞ্জ, মাগুরা, বাগেরহাট, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, খাগড়াছড়ি, গাজীপুর, খুলনা, শেরপুর ও পাবনা জেলাসমূহে ১টি করে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
দেখা যায় বিগত সময়ের মতো বছরের প্রথম সাত দিনেও সড়কে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৪৩ টির মধ্যে ২৯ টি। শতকরা হিসেবে যার হার দাঁড়ায় ৬৭.৪৪ % ভাগ; যা বিগত মাসের পরিসংখ্যান থেকে শতকরা ২৩.৮৪ % ভাগ বেশি। বর্ণিত অবস্থায় উদ্বেগের বিষয়টি কোন পর্যায়ে পৌঁছুতে পারে তা সহজেই ধারণা করা যায়। এমন বাস্তবতায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রস্তুতক্রমে এখনি কার্যকর পরিকল্পনা বাস্তবায়নকল্পে অগ্রসর হওয়া। একইসাথে আমরা প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে আরও বেশি সচেতন হবার পাশাপাশি সমাজ-সংগঠনের তরফ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও আওতাধীন গন্ডীতে কার্যকর ভূমিকা রাখা আশু আবশ্যক।
এআই