সোমবার ০২ অক্টোবর ২০২৩

| ১৬ আশ্বিন ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
১৬:২৪, ১ জানুয়ারি ২০২২

অয়ন সেন গুপ্ত

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংহতি দিবস

প্রকাশের সময়: ১৬:২৪, ১ জানুয়ারি ২০২২

অয়ন সেন গুপ্ত

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংহতি দিবস

পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে মানুষ ছিল নির্বোধ এবং যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল অগঠনমূলক। পরণে পোশাক ছিল না,খাদ্য হিসেবে ছিল কাঁচা ফলমুল,জীবজন্তু সহ প্রকৃতিপ্রদত্ত উপাদান। দলবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করত তারা। প্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা হতে শুরু করে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর। জীবনধারা সহজ করতে তারা নিজেদের মেধা খাটিয়ে সৃজনশীলতার সাথে শুরু করে একের পর এক আবিষ্কার। এভাবেই জন্ম নেয় সভ্যতা।

সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে ওঠে অর্থনীতি। আর অর্থনীতি জন্ম দেয় রাজনীতি নামের একটি নতুন অধ্যায়ের, যা বদলে দেয় পুরো পৃথিবীর রূপরেখা।

অর্থনীতি ও রাজনীতির খেলার এক পর্যায়ে ‘পুঁজিবাদ’ নামের এক বিশেষ ভাইরাস জন্ম নেয়, যা রচনা করেছে মানুষের ভাগ্য, গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে হাজারো নতুন ইতিহাস। যা সৃষ্টি করেছে শ্রেণিতে শ্রেণিতে বৈষম্যের সংগ্রাম। বিশ্বকে ধাবিত করেছে যুদ্ধের দিকে। হ্যাঁ, ‘পুঁজিবাদ’  ইংরেজিতে যাকে বলা হয় "Capitalism"। সহজ ভাষায়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার এবং অর্থনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে উৎপাদন যন্ত্রসমূহ থেকে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন কিংবা ব্যক্তিবিশেষের আয়ত্তে রাখার যে প্রচেষ্টা তাকে পুঁজিবাদ বলা হয়। আর এই পুঁজিবাদীরা নিজেদের স্বার্থে জন্ম দিয়েছে মানুষে মানুষে কিংবা জাতিতে জাতিতে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের। প্রতিযোগিতার এই লড়াইয়ে ক্যাপিটালিস্টরাই হয়েছে নিজেদের মৃত্যুর কারণ। দাসপ্রথা, ধনতন্ত্র, সামন্তবাদ, রাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের উগ্রবাদী চর্চা বিস্তার লাভ করলে যখন যুদ্ধ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে তার প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে তখন পৃথিবীর একাংশ মানুষ খুঁজতে শুরু করে এর থেকে পরিত্রাণের রাস্তা। মানুষ উপলব্ধি করে একমাত্র "সমাজতন্ত্র" এবং "সাম্যবাদ" ই রুখে দিতে পারে সকল অন্যায়, শোষণ। এনে দিতে পারে চিরস্থায়ী মুক্তি। এ ধারায় পৃথিবীর বুকে শুরু হলো অন্যায়, শোষণসহ ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেণির সংগ্রাম। এমন ই এক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পুরো পৃথিবীর পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বিশ্ববাসীর সমর্থনে গড়ে উঠেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র 'ভিয়েতনাম'। আয়তনে অনেক বেশি ছোট হলেও সাম্রাজ্যবাদের প্রভু আমেরিকাকে করতে হয়েছিল যার কাছে নতি স্বীকার। ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস বহু পুরানো। ইতিহাস বলে খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৯ সালে চীনা সেনাপতি ত্রি উ দা প্রথম ভিয়েতনাম দখল করেছিলেন। এভাবে যুগের পর যুগ ক্ষমতা ও শাসনের রদবদলে ভিয়েতকংরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। চীনা,মঙ্গোলীয়দের পরে উপনিবেশবাদের এই প্রতিযোগিতায় মোটামুটি ১৭৮৭-১৮৮৪ সালের দিকেই ফরাসিরা ভিয়েতনাম নিজেদের অধীনস্থ করে ফেলে। ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতকংরা ১৮৬০ সাল থেকেই গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিসংগ্রাম শুরু করে দেয়, যা শেষ হয় ১৯৭৬ সালের ২রা জুলাই সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মাধ্যমে। সে সময় গেরিলা যুদ্ধ তথা মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব চলে যায় 'ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির' হাতে- যার অবিসংবাদী নেতা ছিলেন হো চি মিন। যুদ্ধ তখন পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র, সি আই এ’র গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম কিংবা আমেরিকার সে সময়কার অত্যাধুনিক নাপাম বোমার রোষানলের মুখে লক্ষ লক্ষ শিশুর মৃত্যুও রুখে দিতে পারছিল না ভিয়েতনামী মুক্তিকামী জনগণের স্বাধীনতার লড়াইয়ের যাত্রা। আমেরিকার বিরুদ্ধে ভিয়েতনামীরা যে সামরিক যুদ্ধকৌশল গ্রহণ করেছিল তার নাম ছিল 'এনার্ভেশন'। এটি হলো গেরিলা যুদ্ধের এমন একটি পদ্ধতি যেখানে নিজেদের যতটুক সম্ভব টিকিয়ে রেখে যুদ্ধের সময়কাল বাড়িয়ে শত্রুপক্ষের যুদ্ধ করার রসদ, শক্তি ও ধৈর্যকে দুর্বল করে দেওয়া এবং ভিয়েতনামীরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সফলতা লাভ করেছিল। উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত মিলিয়ে মোটামুটি প্রায় সব দেশের পাশাপাশি খোদ আমেরিকার জনগণ ও গণমাধ্যমগুলো সরাসরি এই যুদ্ধের বিরোধিতা করে ও ভিয়েতনামের পক্ষে অবস্থান নিতে শুরু করে। অবশেষে চীন, জাপান, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে ভিয়েতনাম সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করে কমিউনিস্ট শাসনকে, যা আজো ভিয়েতনামিরা সফলতার সাথে টিকিয়ে রেখেছে।
ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামে প্রাণ দিয়েছিল ত্রিশ লাখের বেশি মানুষ যেখানে ৫৭ হাজার মার্কিন সেনাও ছিল। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই যুদ্ধে বাঙালির অবদানও কম নয়। ভিয়েতনামিদের ওপর মার্কিনিদের হামলার প্রতিবাদে ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি "বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন" ও "ডাকসু" এর নেতৃত্বে একটি যৌথ মিছিল তৎকালীন মার্কিন দূতাবাস অতিক্রম করবার সময় পুলিশ বিনা উসকানিতে গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্থলে শহীদ হন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মির্জা কাদেরুল ইসলাম ও মতিউল ইসলাম। আহত হন ছাত্র ইউনিয়নের অসংখ্য নেতাকর্মী। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের শাসনভার ও ক্ষমতা পরিচালনা করছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই ঘটনায় গোটা দেশের জনগণ উত্তাল হয়ে রাজপথে নেমে আসে। সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয় হরতাল। পরবর্তীতে ভিয়েতনাম সরকার ২০০২ সালে শহীদ মির্জা কাদের ও মতিউল ইসলামকে 'জাতীয় বীর'-এর মর্যাদা দেয় এবং এই দুই বীরের শ্রদ্ধার্থে সে দেশের দুইটি রাস্তার নামকরণ করা হয়। সেইদিনের স্মরণে বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল মানুষ ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো শ্রদ্ধার সাথে প্রতিবছর ১লা জানুয়ারি পালন করে আসছে 'সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংহতি দিবস।'

লাল পতাকার স্লোগানে যে গণজোয়ার সেদিন ভিয়েতনামে গেরিলা বসন্তের ডাক দিয়েছিল সেই জোয়ার আজো অক্ষুণ্ণ রেখেছে সেই দেশ ও দেশের জনগণ। তাদের বিজ্ঞানভিত্তিক গণমুখী জীবনধারা, অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা আজকে তাদের করেছে সমৃদ্ধ। সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, জীবনযাপনে জটিলতা নেই। পৃথিবীর বুকে ছোট্ট সেই দেশটি আজ সারা পৃথিবীতে উন্নয়নের রোল মডেল।

শহীদ ছাত্রনেতা মির্জা কাদের এবং মতিউল নিজেদের জীবন দান করে আমাদের করেছেন অনুপ্রাণিত, শিখিয়েছেন অন্যায় যে জাতির ওপর এবং যে স্থানেই হোক না কেনো- তার বিরুদ্ধে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করার ক্ষমতা। আজকের এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও সংহতি প্রকাশকারী সেই সকল যোদ্ধাদের। শহীদদের আত্মত্যাগ ভুলবার নই।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

"It is scarcely possible anywhere in the world today to raise a body of reasoned support for the opinion that war is a justifiable activity."
   - John Keegan.

অয়ন সেন গুপ্ত
স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক,বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন,চট্টগ্রাম জেলা।