রোববার ২৬ মার্চ ২০২৩

| ১১ চৈত্র ১৪২৯

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
২০:৪৯, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

মহানগর ডেস্ক

নিপাহ ভাইরাস ঝুঁকিতে দেশের ৩২ জেলা, সতর্ক করল স্বাস্থ্য অধিদফতর

প্রকাশের সময়: ২০:৪৯, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

মহানগর ডেস্ক

নিপাহ ভাইরাস ঝুঁকিতে দেশের ৩২ জেলা, সতর্ক করল স্বাস্থ্য অধিদফতর

নিপাহ ভাইরাস

দেশের নিপাহ ভাইরাসে এখন পর্যন্ত ১০ জন শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৭ জন মারা গেছেন। বিপজ্জনক এই ভাইরাসে দেশের ৩২ জেলা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে এ ভাইরাসে শনাক্তের সংখ্যা বেশি ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে। 

জানা গেছে, মূলত ফল আহারি বাদুড় নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহক। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিপাহ ভাইরাস রোগের কোনো টিকা এবং সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, সতর্কতা ও সচেতনতাই এ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। খেজুরের কাঁচা রস পান করা যাবে না এবং পাখি খাওয়া ফল খাওয়া যাবে না।

নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে মহাখালীর ‘ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল’ প্রস্তুতি নিয়েছে। ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শফিকুর রহমান বলেন, হাসপাতালে ১৫ শয্যার আইসিইউ ও ১০ শয্যার আইসোলেশন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এখনও কোনো রোগী ভর্তি হয়নি বলে তিনি জানান।

১৯৯৮-৯৯ সালে নিপাহ ভাইরাস রোগের প্রথম প্রাদুর্ভাব মালয়েশিয়ার সুঙ্গাই নিপাহ নামক গ্রামে দেখা দেয়। এ গ্রামের নামেই ভাইরাসটির নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশে ২০০১ সালে দেশে প্রথম নিপাহ ভাইরাসে শনাক্ত রোগী পাওয়া যায়। ২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ৩৩৫ জনের দেহে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৩৫ জন মারা গেছে। অর্থাৎ এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে। এ বছর নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ১০ জন।

সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (আইইডিসিআর) তথ্যানুযায়ী, রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলায় এক নারী (৩৫) নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। গত ৫ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। নওগাঁ জেলায় এক কিশোর (১৩) আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ১১ জানুয়ারি থেকে চিকিৎসাধীন। নওগাঁর আরেক নারী গত ৬ জানুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় একটি ছেলেশিশু (৭)। 

ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ী জেলার বালাকান্দি উপজেলায় এক কন্যাশিশু (৬) গত ২১ জানুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। বালাকান্দি উপজেলার আরেক নারী (২৮) গত ২৪ জানুয়ারি থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একই জেলার গোয়ালন্দ উপজেলায় এক যুবক (১৮) হাসপাতালে ১৯ জানুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার এক পুরুষ (২৯) গত ১৭ জানুয়ারি থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রাজধানীতে রমনায় এক নারী গত ১৯ জানুয়ারি থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

যেসব জেলায় এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়েছে সেসব জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সর্তকতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। 

২২ বছরে মৃত্যু  

আইইডিসিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২২ বছরে (২০০১-২০২৩) নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হওয়া ৩৩৫ রোগীর মধ্যে মারা গেছেন ২৩৫ জন। মৃত্যুর হার প্রায় ৭১ শতাংশ। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১০ জনের নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে মারা গেছে পাঁচজন। মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ। ২০২২ সালে তিনজন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে মারা যায় দুইজন। মৃত্যুর হার ৬৭ শতাংশ। ২০২১ সালে দুজন শনাক্ত হলেও কেউ মারা যায়নি। ২০২০ সালে সাতজন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে মারা যায় পাঁচজন। মৃত্যুর হার ৭১ শতাংশ। ২০১৯ সালে আটজন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে মারা যায় সাতজন। মৃত্যুর হার ৮৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে শনাক্ত চারজনের মধ্যে মারা যায় দুজন। মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ। ২০১৭ সালে শনাক্ত তিনজনের মধ্যে দুজন মারা যায়। মৃত্যুর হার ৬৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে কেউ শনাক্ত হয়নি। 

২০১৫ সালে ১৫ জন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে ১১ জন মারা যায়। মৃত্যুর হার ৭৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে শনাক্ত ৩৭ জনের মধ্যে ১৬ জন মারা যায়। মৃত্যুর হার ৪৩ শতাংশ। ২০১৩ সালে ৪১ জন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে ২৫ জন মারা যায়। মৃত্যুর হার ৮১ শতাংশ। ২০১২ সালে ১৭ জন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে ১২ জন মারা যায়। মৃত্যুর হার ৭১ শতাংশ। ২০১১ সালে শনাক্ত ৪৩ জনের মধ্যে মারা যায় ৩৭ জন। মৃত্যুর হার ৮৬ শতাংশ। ২০১০ সালে শনাক্ত হয় ১৮ জন, তাদের মধ্যে ১৬ জন মারা যায়। মৃত্যুর হার ৮৯ শতাংশ। ২০০৯ সালে চারজন শতাংশ হয়, তাদের মধ্যে মারা যায় একজন। মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ। 

২০০৮ সালে ১১ জন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে সাতজন মারা যায়। মৃত্যুর হার ৬৪ শতাংশ। ২০০৭ সালে ১৮ জন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে ৯ জন মারা যায়। মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ। ২০০৬ সালে কেউ শনাক্ত হয়নি। ২০০৫ সালে ১২ জন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে মারা যায় ১১ জন। মৃত্যুর হার ৯২ শতাংশ। ২০০৪ সালে ৬৭ জন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে ৫০ জন মারা যায়। মৃত্যুর হার ৭৫ শতাংশ। ২০০৩ সালে ১২ জন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে মারা যায় আটজন। মৃত্যুর হার ৬৭ শতাংশ। ২০০২ সালে কেউ শনাক্ত হয়নি। ২০০১ সালে ১৩ জন শনাক্ত হয়, তাদের মধ্যে ৯জন মারা যায়। মৃত্যুর হার ছিল ৬৯ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শেখ দাউদ আদনান জানান, দেশের ৩২টি জেলা নিপাহ ভাইরাসজনিত জ্বরের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের প্রতি হাসপাতালে জ্বরের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য কর্তব্যরত চিকিৎসকদের রোগী দেখার সময় আবশ্যিকভাবে মাস্ক পরতে করতে হবে। রোগী দেখার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। জ্বরের উপসর্গ দেখা গেলে রোগীকে আবশ্যিকভাবে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি রাখতে হবে। জ্বরের সঙ্গে সংকটাপন্ন অবস্থা দেখা দিলে রোগী সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের আইসিইউতে রাখতে হবে। আইসিইউতে থাকাকালে রোগীর পরিচর্যাকারীরা শুধু গ্লাভস, মাস্ক পরলেই হবে। কেননা আক্রান্ত রোগীর থেকে বাতাসের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ায় না। তিনি আরও জানান, যেহেতু আইসিইউতে রেখে এই রোগীর চিকিৎসা করা যায়, এ জন্য রেফার্ড করার প্রয়োজন নেই।

রোগের লক্ষণ

নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৫ থেকে ১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াও ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় শরীরের মধ্যে থাকতে পারে। শুরুতে প্রচণ্ড জ্বর, মাথা ও পেশিতে ব্যথা, খিচুনি, শ্বাসকষ্ট, কাশি, পেট ব্যথা, বমি ভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এ রোগে মস্তিষ্কে এনসেফালাইটিস জাতীয় ভয়াবহ প্রদাহ দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে রোগী প্রলাপ বকতে শুরু করে, ঘুমঘুম ভাব, মানসিক ভারসাম্যহীনতা এবং অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না হলে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. ফেরদৌস আহমেদ বলেন, নিপাহ ভাইরাসের কোনো টিকা নেই। কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাও নেই। এ ভাইরাসে আক্রান্তের পরিস্থিতির অবনতি হলে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া অথবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

চিকিৎসা ও করণীয় 

নিপাহর পরীক্ষা এলাইজা টেস্ট, পিসিআর, সেল কালচার প্রভৃতি পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব। এখন পর্যন্ত এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। রোগের লক্ষণ দেখামাত্রই রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, প্রয়োজনে আইসিইউও লাগতে পারে। সাধারণত লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়, প্রয়োজনে এন্টিভাইরাল ব্যবহার করা যায়। আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে জীবন রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। খেজুরের কাঁচা রস পান করা যাবে না। পাখি বা বাদুড়ে খাওয়া আংশিক ফল যেমন: আম, লিচু, জাম, জামরুল, গোলাপজাম, কাঁঠাল, ডেউয়া, পেঁপে, পেয়ারা, বরই ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো। ফলমূল পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে খেতে হবে। আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে এবং রোগীর পরিচর্যা করার পর সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।

এ বিষয়ে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, নিপাহ ভাইরাস খুবই মারাত্মক ও বিপজ্জনক। এ ভাইরাস থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়া এবং পাখি আংশিক খাওয়া ফলমূল খাওয়া থেকে বিরত থাকা। তিনি বলেন, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে প্রতি বছরই নিপাহ ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আক্রান্তদের বেশির ভাগই মারা যায়। তিনি বলেন, ১০০ জন আক্রান্ত হলে ৭১-৭২ শতাংশ মানুষ মারা যাচ্ছে। তিনি বলেন, কোনো ঢাকনাতেই নিপাহ প্রতিরোধ করা যায় না। তাই কোনোভাবেই খেজুরের কাঁচা রস পান করা যাবে না। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।

এসএ