
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করছে
বাংলাদেশের জন্য দিন দিন বিষফোঁড়া হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ দিনদিন বাড়ছে। একই সঙ্গে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটছে। তাছাড়া কক্সবাজারে স্থানীয় বাসিন্দাদের আতঙ্কের অন্যতম কারণ ‘রোহিঙ্গারা’। বাংলাদেশের জন্য ‘মাথাব্যাথা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিপুল সংখ্যাক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করছে। এই হিসাবে ৪ বছরে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা শিবিরে পরিবার পরিকল্পনা জোরদারের জন্য জাতিসংঘকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। রোববার রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম জোরদার করার জন্য জাতিসংঘকে অনুরোধ করেছি। তারা শিগগিরই কাজ শুরু করবে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমরা সব মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতির কথা বলে আসছিলাম। প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশুর জন্ম হিসাবে গত ৪ বছরে আরও ১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বেড়েছে।’
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল। আর এ বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৩।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে অক্টোবরে রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে। এর আগে থেকে বাংলাদেশে নিবন্ধিত–অনিবন্ধিত মিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতি ছিল।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, এখন পর্যন্ত কক্সবাজার থেকে ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ এখন পর্যন্ত সেখানকার কর্মকাণ্ডে পুরো মাত্রায় যুক্ত হয়নি।
বাড়ছে মাদক বাণিজ্য ও অপরাধ
‘দিনে দিনে যেভাবে রোহিঙ্গাদের দাপট বাড়ছে তাতে আমরা স্থানীয়রা কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছি। সন্ধ্যা নামতেই আতঙ্ক ভর করে আমাদের। এদিকে রাত বাড়তে থাকলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। ইদানীং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে প্রায়ই গোলাগুলি এবং খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। কক্সবাজারের উখিয়ায় এক স্থানীয় বাসিন্দা নিজেদের আতঙ্কের কথা এভাবেই প্রকাশ করেন।
স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গাদের হাতে যেভাবে কাঁচা টাকা আসছে, এতে তারা ক্যাম্পের বাইরে বাংলাদেশিদের সহযোগিতা নিয়ে জমিজমা কিনে ঘরবাড়ি করছে। কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলেও তারা অনেকেই অংশীদার, এটাও সবাই জানে। দিনে দিনে তারা আমাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয় পাচ্ছে। তারা জাতীয় পরিচয়পত্র বানাচ্ছে। বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে চাঁদাবাজি ও অপহরণের ঘটনা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, রোহিঙ্গাদের দ্রুত তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। না হয় তাদের এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যেতে হবে। না হলে পুরো কক্সবাজার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।
স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিন যত যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ততই বাড়ছে। এর মধ্যে ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) অন্তত সাত-আটটি গ্রুপ সক্রিয়। এতে মিয়ানমারের ইন্ধনও রয়েছে। মিয়ানমার থেকে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সহযোগিতাও করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই তারা অর্থ উপার্জন এবং বিভিন্ন অপরাধে ঝুঁকে পড়ছে।
এদিকে গত ৪ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া ৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একদল দুর্বৃত্তের হামলায় হেডমাঝিসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। ওইদিন রাত ৮টার দিকে ওই ক্যাম্পের এফ-১৩ ব্লকে এ ঘটনা ঘটে।
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৯৯টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, রোহিঙ্গারা খুনোখুনি, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এবং ধর্ষণসহ অন্ততপক্ষে ১৪ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এসব অপরাধের অভিযোগে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত থানায় ১ হাজার ৯০৮টি মামলা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ার ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিলেন মুহিবুল্লাহ। সেদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে উখিয়ার লাম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একদল দুর্বৃত্ত তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। এর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। বিষয়টি মুহিবুল্লাহ তার ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছিলেন। এ ঘটনার পর থেকে তার পরিবারের সদস্যরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসাকে দায়ী করে আসছে। এরপর গত ২২ অক্টোবর ১৮ নম্বর ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে গুলি করে ছয় ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, গত আড়াই মাসে আরসার দুই নেতাসহ অন্তত পাঁচজন খুন হয়েছে। গত ১ আগস্ট বিকেলে মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নুরুল আমিন (২৬) নামে এক রোহিঙ্গা যুবক খুন হন। ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশনের ‘আই’ ব্লকে এ হত্যাকাণ্ড হয়। নিহত নুরুল ওই ক্যাম্পের আবু শামার ছেলে।
এছাড়া গত ২২ জুন আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং এর আগে ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১০ জুন কুতুপালংয়ের ৪ নম্বর ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ সমিন (৩০) এবং ৯ জুন রোহিঙ্গা নেতা আজিম উদ্দিনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানাউল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬) নামে এক স্বেচ্ছাসেবক। এর এক সপ্তাহের ব্যবধানে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড শীর্ষ সন্ত্রাসী হাসিমের সহযোগী মো. শাহকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘রোহিঙ্গারা শরণার্থী নয়, এরা মূলত বাস্তুচ্যুত। তারা জানে তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা যেমন কম তেমনই বাংলাদেশেও তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাই নিজেদের লাভের জন্য তারা নানান অপকর্মে জড়াচ্ছে। কেউ মাদক ব্যবসা করছে, কেউ অস্ত্র পাচার আবার কেউ মানব পাচারে লিপ্ত। তারা আসলে তাদের অর্থনৈতিক আখের গোছাতে অপরাধে জড়াচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিকল্প আসলে নেই। তবে এখন যত বেশিসংখ্যককে ভাসানচরে পাঠানো যায় তত ভালো। আর তাদের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে।
কেডি