সোমবার ০২ অক্টোবর ২০২৩

| ১৬ আশ্বিন ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
১৬:১৪, ১৭ জানুয়ারি ২০২২

বিশেষ প্রতিনিধি

করোনার ‘হঠাৎ ঝড়’—৩ কারণে বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম

প্রকাশের সময়: ১৬:১৪, ১৭ জানুয়ারি ২০২২

বিশেষ প্রতিনিধি

করোনার ‘হঠাৎ ঝড়’—৩ কারণে বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম

করোনার ‘হঠাৎ ঝড়’

পুরোনো ডেলটা ধরনের সঙ্গে মাঠে নেমেছে নতুন ওমিক্রন, দুইয়ে মিলে হঠাৎ করোনা ‘ঝড়’ শুরু হয়েছে দেশে। নতুন বছরের শুরু থেকেই শনাক্তের হারে বড় ধরনের ঊর্ধ্বগতি দেখছে দেশ। প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। থেমে নেই করোনা রোগীর মৃত্যুও।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার দুই ধরন- ডেলটা ও ওমিক্রনের দাপটে এখন দেশজুড়ে সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। সারাদেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংক্রমণ বাড়ছে চট্টগ্রামেও। সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণের হার জ্যামিতিক হারে বেড়ে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরা।

দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ২৩ থেকে ৭৪২

চট্টগ্রামে সর্বশেষ ৭২ ঘণ্টার করোনা শনাক্তের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। ১৫ জানুয়ারি আগের ২৪ ঘণ্টায় জানা গিয়েছিল ২৩৯ জনের করোনা শনাক্তের খবর। মাঝখানে একদিনের ব্যবধানে ১৭ জানুয়ারি (আজ) সেই সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে ৭৪২ জনে। অথচ মাত্র দুই সপ্তাহ আগে, ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামে করোনা শনাক্ত হয় ২৩ জনের নমুনায়।

এরমধ্যে শনিবার (১৫ জানুয়ারি) আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের এক হাজার ৯৪৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ২৩৯ জনের করোনা শনাক্তের খবর জানিয়েছিল জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। শনাক্তের হার ছিল ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ।
রোববার (১৬ জানুয়ারি) আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের এক হাজার ৯৮৩টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫৫০ জনের করোনা শনাক্তের খবর মেলে। শনাক্তের হার ছিল ২৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
সর্বশেষ সোমবার (১৭ জানুয়ারি) আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের দুই হাজার ৮৮৩টি নমুনা পরীক্ষা করে ৭৪২ জনের করোনা শনাক্তের খবর জানিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। শনাক্তের হার ২৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

অথচ এই চট্টগ্রাম জেলাতেই মাত্র দুই সপ্তাহ আগে তিনদিনে করোনা শনাক্ত হয় মাত্র ৪৮ জনের। শনাক্তের হারও ছিল অনেক কম। এরমধ্যে ১ জানুয়ারি ৯ জন (শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ), ২ জানুয়ারি ১৬ জন (১ দশমিক ৫৯ শতাংশ) এবং ৩ জানুয়ারি ২৩ জনের (১ দশমিক ৫৭ শতাংশ) করোনা শনাক্ত হয়। আগের ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার ভিত্তিতে এসব তথ্য জানায় জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়।

৩ কারণে বড় ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম

মূলত তিনটি কারণে করোনা সংক্রমণে বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই সতর্ক না হলে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতে ‘বিপর্যয়’ নেমে আসতে পারে।

প্রস্তুতির অভাব, বন্ধ অধিকাংশ আইসোলেশন সেন্টার

বছরের বড় সময়জুড়ে ডেলটা ধরনের দাপটের পর ২০২১ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রামে কমতে থাকে করোনা রোগীর সংখ্যা। নিয়মিত শতকের ঘর পার করা করোনা রোগীর সংখ্যা একপর্যায়ে নেমে আসে ‘সিঙ্গেল ডিজিটে’।

এরপর একে একে বন্ধ হতে থাকে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় শুরু হওয়া করোনা আইসোলেশন সেন্টারগুলো। করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোও অন্য চিকিৎসায় মনোযোগী হয়। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেও সাধারণ রোগীদের ব্যস্ততা বাড়তে শুরু করে। একইসঙ্গে করোনার টিকার ‘রুটিন’ দায়িত্বও বন্ধ থাকেনি।

এরমধ্যেই হঠাৎ করেই ওমিক্রনের আঘাত ও দেশজুড়ে করোনা সংক্রমণ বাড়ার খবর মেলে। শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে চট্টগ্রামেও।

স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব কম সময়ের মধ্যে করোনার এই হঠাৎ ঊর্ধ্বগতিকে ঘিরে প্রয়োজনীয় পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়ার সময় পায়নি চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ। যে কারণে রোগীর সংখ্যা বাড়লে বড় বিপাকে পড়তে হতে পারে।   

থমকে গেছে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ও কন্টাক্ট ট্রেসিং

করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে খুব পরিচিত তিনটি শব্দ ছিল কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ও কন্টাক্ট ট্রেসিং। কিন্তু দিন যত যায়, তত ঢিল পড়তে এই তিন সতর্কাবস্থায়।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনা রোগীদের আইসোলেশন, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন কিংবা সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে কন্টাক্ট ট্রেসিং- তিনটির কোনোটিই সেভাবে করতে দেখা যায়নি প্রশাসন থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষকে। যে কারণে সতর্কাবস্থার দুর্বলতায় সংক্রমণ আরও বাড়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।   

সামাজিক দূরত্ব-স্বাস্থ্যবিধিকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি’

দেশজুড়ে করোনা সংক্রমণ বাড়ার প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা ১১ দফা বিধিনিষেধ বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামে তা মানতে দেখা গেছে খুব কম মানুষকেই।

মাস্ক ছাড়াই ঘুরছেন অনেকে। জনসমাগমের স্থানে এখনও ভিড়। স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই অধিকাংশ মানুষের মধ্যে। সবমিলিয়ে বিধিনিষেধের বেড়াজাল কাগজে থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ তেমন একটা নেই বললেই চলে। যে কারণে প্রতিদিন বাড়ছে সংক্রমণের ঝুঁকি।

স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ওমিক্রনসহ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে তাতে আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তির কোনো জায়গা নাও থাকতে পারে।

তিনি বলেন, আমরা টিকা দিয়ে যাচ্ছি, পাশাপাশি আমাদের ওমিক্রন ও ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তাতে আমরা কিছুটা হলেও চিন্তিত ও আতঙ্কিত।

জাহিদ মালেক বলেন, গত বছর ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণের হার ২৯-৩০ শতাংশে উঠেছিল। এখন ধাপে ধাপে বাড়ছে, এভাবে বাড়লে ৩০ শতাংশে পৌঁছাতে সময় লাগবে না। হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যাও বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে হাসপাতালে রোগী ভর্তির কোনো জায়গা থাকবে না। তখন চিকিৎসা দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ সরকারি ১১ দফা নির্দেশনা মেনে না চললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

তিনি বলেন, দেশে ওমিক্রনের সংক্রমণ আগের তুলনায় বাড়লেও এখনও ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। আইইডিসিআর (সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে করোনা আক্রান্ত রোগীদের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং পরীক্ষায় দেখা গেছে, ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীই ৮০ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, শুধু পরীক্ষা ও শনাক্ত করলেই চলবে না। সারাদেশে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বহু মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করছে। এতে করোনার সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে না চললে সংক্রমণ ও মৃত্যুঝুঁকি আরও বাড়বে বলেও সতর্ক করেন তিনি।

মহানগরনিউজ/এমএন