
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে মোট শিশুর সংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। গত পাঁচ বছরে টেকনাফ উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে জন্মলাভ করেছে দুই লাখেরও বেশি শিশু।
জাতিসংঘ শরাণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিসংখ্যান জানায়, বর্তমানে প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুক্ত হচ্ছে গড়ে ৯০ শিশু। ফলে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে বর্তমানে সাড়ে ১৪ লাখে দাঁড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের মধ্যে একাধিক বিয়ে ছাড়াও বাল্যবিয়ের প্রবণতা বাড়ছে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে অধিক সন্তান জন্মদানবিরোধী নানা প্রচার-প্রচারণা চললেও বস্তুত সেটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গারা এভাবে সন্তান জন্ম দিতে থাকলে একদিন টেকনাফ-উখিয়াসহ কক্সবাজারজুড়ে স্থানীয় অধিবাসীরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে; পাল্টে যাবে সেখানকার জনমিতি।
ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযায়ী, টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৩টি ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ৫৮ হাজার। ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত করা নিবন্ধনের হিসাব এটি। অনিবন্ধিত শিশুরা রয়ে গেছে এ হিসাবের বাইরে। ক্যাম্পগুলোতে আশ্রিতদের মধ্যে ৫২ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অফিসের তথ্য বলছে, ২০১৭ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জন্মনিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নারীদের মধ্যে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৩০০ পিল, পুরুষদের মধ্যে ৭৮ হাজার ৩২৫ কনডম বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩ লাখ ১০ হাজার ২৫৬ জনকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন প্রয়োগ ও ১৪ হাজার ৪৬২ জনকে ইমপ্লান্ট করা হয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা অফিসের উপপরিচালক পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য জানান, আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণে উৎসাহিত করতে ক্যাম্পগুলোতে সর্বোচ্চ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। তিনি জানান, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধিত মোট শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ৫৮ হাজার। পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৫টি এনজিওর ৩ হাজার ৫০০ কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছেন। এ ছাড়া পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে স্থানীয় মসজিদগুলোর মাধ্যমে ইসলামের আলোকে সচেতনতা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পরবর্তী স্বল্প সময়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে আসে। ওই সময় আসা নারীদের ৩০ হাজারের বেশি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। ফলে পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই ক্যাম্পগুলোয় প্রচুর শিশুর জন্ম হয়। ইউএনএফপিএর আরেকটি তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ৩০ হাজার অন্তঃসত্ত্বার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি সেবাকেন্দ্রগুলোতে মাত্র চার হাজার শিশুর জন্ম হয়। অবশিষ্ট শিশুর জন্ম হয় আশ্রয়শিবিরেই।
এর আগে শরণার্থীবিষয়ক এক সভায় বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়ার কথা বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রতিবছর ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্মের তথ্য তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত কিংবা পালিয়ে আসা বাবা-মায়ের মতোই অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশ্রয় শিবিরে কাটছে রোহিঙ্গাদের শৈশব। অল্প বয়সেই কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রাস, মাদক পাচারসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু এলাকার শূন্যরেখায় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে আটকে আছেন কিছু রোহিঙ্গা। সেখানে বর্তমানে ৬২২ পরিবারের চার হাজার ৩৩ রোহিঙ্গার একটি শিবির রয়েছে। দুবছর আগে শিবিরের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ছয় হাজার। এ সময়ের মধ্যে কিছু রোহিঙ্গা অন্যত্র সরে পড়ায় সেখানে লোকসংখ্যা সামান্য কমেছে।
শূন্যরেখায় বাস করা রোহিঙ্গা মো. আমিন বলেন, আশ্রয় নেওয়ার সময়েই এখানে দুই শতাধিক শিশু জন্ম নেয়। আমাদের জীবন তো অন্ধকারেই ফুরিয়ে গেল। কিন্তু এ শিশুদের জীবনও কি তেমন হবে? এখানে অন্য শরণার্থী শিবিরের মতো ত্রাণ পৌঁছে না। নেই পর্যাপ্ত খাবার পানি, টয়লেট, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। এখানকার শিশুদের জীবনে শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। তাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে। আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে। তবে কাজটা খুব কঠিন।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছু দৌজা নয়ন বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে ছিল। ফলে এটা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। এর পরও তাদের সচেতন করতে নানা কর্মসূচি চলছে।
কেডি