
ফাইল ছবি
সুদূর আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেও ইসলাম ধর্ম প্রচারে ভারতবর্ষে এসেছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক বাবা আদম। উপমহাদেশে সেন শাসনামলে ১১৭৮ সালে ধলেশ্বরীর তীরে মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিমে আসেন তিনি। তখন বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জ ছিল বল্লাল সেনের রাজত্বে। ওই বছরই বল্লাল সেনের হাতে প্রাণ দিতে হয় তাঁকে।
শহীদ বাবা আদমকে মিরকাদিমের দরগাবাড়িতে দাফনের পর তাঁর মাজারের পাশে ১৪৮৩ সালে নির্মাণ করা হয় বাবা আদম মসজিদ। এটি ছিল তাঁর মৃত্যুর ৩১৯ বছর পরের ঘটনা। সেই থেকে ৫৩০ বছর ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে এই মসজিদটি। কিন্তু মুসলিম ঐতিহ্যের চোখজুড়ানো এই শৈল্পিক স্থাপনার গায়ে এখন শুধুই অযত্ন-অবহেলার ছাপ।
তৎকালীন ভারতবর্ষে যে কটি প্রাচীন মসজিদ ছিল, সেগুলোর একটি বাবা আদম মসজিদ। বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহর শাসনামলে তাঁর আগ্রহে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরের অদূরে তায়েফে ১০৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন ইসলাম ধর্ম প্রচারক বাবা আদম। পরবর্তী সময়ে আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর সাহচর্য পেতে বর্তমান ইরাকের বাগদাদে আসেন। সেখানে শিক্ষাগ্রহণ করেন তিনি।
বাবা আদম শহীদ মসজিদ মুন্সীগঞ্জ জেলার রামপালের অন্তর্গত রিকাবিবাজার ইউনিয়নের কাজী কসবা গ্রামে অবস্থিত। মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে চার কিলোমিটার পথ পেরোলেই বাবা আদম মসজিদ।
তথ্য মতে, প্রায় ৫৩৪ বছরের পুরনো বাবা আদম মসজিদ। সুদূর আরব দেশে জন্মগ্রহণ করে ইসলাম ধর্ম প্রচারে ভারতবর্ষে এসেছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক বাবা আদম (রহ.)। উপমহাদেশে সেন শাসনামলে ১১৭৮ সালে ধলেশ্বরীর তীরে মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমে আসেন তিনি। তখন বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ ছিল বল্লাল সেনের রাজত্বে। ওই বছরই বল্লাল সেনের হাতে প্রাণ দিতে হয় তাকে। এ বিষয়ে নানা কল্পকথা ও স্থানীয় জনশ্রুতি রয়েছে।
শহীদ বাবা আদমকে মীরকাদিমের দরগাবাড়ীতে দাফনের পর তার কবরের পাশে ১৪৮৩ সালে নির্মাণ করা হয় বাবা আদম মসজিদ। এটি ছিল তার মৃত্যুর ৩১৯ বছর পরের ঘটনা।
এদিকে শাহ হুমায়ুন কবির The Battle of Kanai Changue গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাবা আদম শহীদ (রহ.) আরবের তায়েফ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে খানকাহ নির্মাণ করে ইসলাম প্রচার করেন। তিনি ১১৪২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে আসেন। সেখান থেকে ১১৫২ খ্রিষ্টাব্দে মুন্সীগঞ্জ সদরের প্রাচীন রামপালনগরে আসেন। মুন্সীগঞ্জ এলাকার কপালদুয়ার, মানিকেশ্বর ও ধীপুরে তিনটি খানকাহ নির্মাণ করে ইসলাম প্রচার করেন।’
এলাকাবাসীর মতে, বাবা আদমের নামে নির্মিত এ মসজিদটি দেখতে বছরজুড়ে দরগাবাড়িতে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটক ও দর্শনার্থীরা। তবে পর্যটকদের আকর্ষণ ধরে রাখা কিংবা কয়েক শ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা এ স্থাপনাটি সংরক্ষণে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ।
বইপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতবর্ষ প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ১৯০৯ সালে একবার এ মসজিদটি সংস্কার করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরপর দীর্ঘ সময় সেভাবেই ফেলে রাখা হয়। ১৯৯১ সালের দিকে এর চারপাশে লোহার সীমানা বেড়া নির্মাণ করা হয়। সে বছরই বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ মসজিদের ছবি দিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশ করে। মসজিদটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে এটাই ছিল সরকারের উল্লেখ করার মতো কোনো পদক্ষেপ। সম্প্রতি বাবা আদম মসজিদ পরিদর্শন করে দেখা যায়, দীর্ঘদিন পরিচর্যার অভাবে মসজিদের দেয়ালে শেওলা পড়েছে। মসজিদে আশপাশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা নামাজ পড়ছেন।
মসজিদ ও মাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মজিবর রহমান জানান, প্রায় ১২ বছর আগে একবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে সংস্কার ও রং করা হয়েছিল। এরপর আর তাদের দেখা মেলেনি। তবে এখন তাঁরা নিজেরা মূল কাঠামো ঠিক রেখে মসজিদটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন।
ছয় গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদের নির্মাণশৈলী মনোমুগ্ধকর। মসজিদের উচ্চতা প্রায় ১৮ ফুট। এটি দৈর্ঘ্যে ৪৩ ফুট ও প্রস্থে ৩৬ ফুট। দেয়াল প্রায় চার ফুট চওড়া। ইট-সুরকি দিয়ে ভেতরে গাঁথা। মসজিদের ভেতরে ঢুকে সামনে এগোলে চার কোনায় চারটি ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভ চোখে পড়ে। মসজিদের খিলান, দরজা, স্তম্ভের পাদদেশ, মেঝে ও ছাদের কার্নিশের নিচে ইট কেটে মুসলিম স্থাপত্যকলার অপূর্ব নকশাও লক্ষ করা যায়। ছাদ বাংলাদেশের আবহাওয়ার কথা বিবেচনা করে উত্তর-দক্ষিণে ঈষৎ ঢালু রেখে নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদে প্রবেশের জন্য তিনটি দরজাও রয়েছে। মসজিদটি নির্মাণের সময় লাল পোড়ামাটির ১০ ইঞ্চি, সাত ইঞ্চি, ছয় ইঞ্চি ও পাঁচ ইঞ্চি মাপের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের ভেতরে দু’টি স্তম্ভ রয়েছে।
প্রধান মেহরাবটি এবং দুই পাশের দুই মেহরাব ও পাশের দেয়াল লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা ও গোলাপফুল, ঝুলন্ত প্রদীপ ও শিকল প্রভৃতি অত্যন্ত সুন্দর পোড়ামাটির চিত্র ফলক দিয়ে অলঙ্কৃত। মসজিদের বাইরের দিক বিশেষ করে সামনের দেয়াল অতি সুন্দর পোড়ামাটির চিত্রফলক দিয়ে অলঙ্কৃত। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের দুই পাশে কিছু কিছু চিত্রফলকের কাজ এখনো চোখে পড়ে।
এটি ১৯৪৮ সাল থেকে পুরাতত্ত্ব বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৯১-৯৬ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বাবা আদম মসজিদের ছবিসংবলিত ডাকটিকিট প্রকাশ করে। কারুকার্যখচিত এ মসজিদ নির্মাণে সময় লেগেছিল চার বছর। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে মাঝখানের দরজার ঠিক উপরে একটি আরবি শিলালিপি রয়েছে। শিলালিপির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন ব্লকম্যান।
৫৩৫ বছর ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে এই মসজিদটি। কিন্তু মুসলিম ঐতিহ্যের চোখ জুড়ানো এই শৈল্পিক স্থাপনার গায়ে এখন শুধুই অযত্ন-অবহেলার ছাপ। ভারতবর্ষ প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ১৯০৯ সালে একবার এ মসজিদটি সংস্কার করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরপর দীর্ঘ সময় সেভাবেই ফেলে রাখা হয়। ১৯৯১ সালের দিকে এর চারপাশে লোহার সীমানা বেড়া নির্মাণ করা হয়। ব্যস, এ পর্যন্তই।
এসএ