
জলকদর খালের দুই পাড়ের বিভিন্ন অংশে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে
চট্টগ্রামের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী উপজেলা ‘বাঁশখালী’। উপজেলার এক পাশে পাহাড় আর অন্য পাশে বঙ্গোপসাগর, মাঝখানে সরল রেখার মতো দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরে চলে গেছে জলকদর খাল। মূলত বাঁশখালীকে দুই খণ্ডে বিভক্ত করেছে ঐতিহ্যবাহী এ খাল। এর পশ্চিম পাড় পশ্চিম বাঁশখালী এবং পূর্ব পাড় পূর্ব বাঁশখালী হিসেবে পরিচিত। এটি অনেক ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এটি শঙ্খ নদী থেকে শুরু হয়ে উজানঠিয়া খালের সঙ্গে মিশেছে। আবার বাগড়া চিংড়ি চাষের জন্যও বিখ্যাত। এছাড়া পাশ্ববর্তী জনপদের মানুষের জীবন-জীবিকার উৎসও এটি।
বাঁশখালীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৫০ বর্গমাইলের এ উপজেলার ঐতিহ্যের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে জলকদর খাল। খানখানাবাদের উত্তর সীমান্তে ঈশ্বরবাবুর হাট পয়েন্ট ও রাতারকুল গ্রামের জেলেপাড়া ঘেঁষে জলকদর সাঙ্গু নদীতে মিলিত হয়েছে। মোহনাটি লোকালয়ে কুঁরিচোরা ঘাট নামে পরিচিত। এর পূর্বপাশে রাতাখোর্দ্দ গ্রাম ছিল, যা শঙ্খের ভাঙনে আজ বিলীন। তাছাড়া মোহনার উত্তর পাশে শঙ্খের ওপারে আনোয়ারার জুইদণ্ডী গ্রামের অবস্থান। উত্তরে কুঁরিচোরা ঘাট থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৩২ কি.মি দীর্ঘ এই জলকদর বাঁশখালীকে দু’ভাগে বিভক্ত করে গন্ডামারা থেকে একটি ধারা খাটখালী হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। খাটখালী ঘাটের দক্ষিণ পাশে ছনুয়া ও উত্তরপাশে গন্ডামারার অবস্থান এবং মোহনার বিপরীত পাশে রয়েছে কুতুবদিয়া দ্বীপ। অন্যধারাটি গন্ডামারা থেকে পূর্বদক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে পেকুয়ার বারবাকিয়ার দিকে চলমান।
জলকদর খাল দ্বারা বিভক্ত বাঁশখালীর পশ্চিমে রয়েছে খানখানাবাদ, বাহারছড়া, গন্ডামারা ও ছনুয়া ইউনিয়ন। যে এলাকাটি পশ্চিম বাঁশখালী নামে পরিচিত। এর আরও পশ্চিমে রয়েছে বিশাল সমুদ্র। কোথাও সবুজ ঘাসে ঘেরা অনাবাদি জমি, লবণ মাঠ আবার কোথাও সমুদ্রতীরের সারি সারি ঝাউ বাগানের বিশালতায় পরিবেষ্টিত বাঁশখালীর পশ্চিম পাশটি।
বাঁশখালী জনপদের জন্য জলকদর খালটি স্রষ্টার একটি আশীর্বাদও বটে। কেননা জলকদর খালের সঙ্গে যুক্ত বাঁশখালীর পূর্বাঞ্চলের আটটি ছড়ার (পুঁইছড়ির ছড়া, নাপোড়া ছড়া, চাম্বলের ছড়া, শীলকূপের বামের-ডানের ছড়া, জলদী ছড়া, পাইরাংয়ের ছড়া, কালীপুরের ছড়া ও সাধনপুরের ছড়া) পাহাড়ি ঢলের পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। এছাড়া খালটি শঙ্খ নদী হয়ে খানখানাবাদের অভ্যন্তরে বাহারছড়া, কাথারিয়া, সরল, গন্ডামারা, শীলকূপ, ছনুয়া, শেখেরখীল মধ্যবর্তী স্থান হয়ে আবারও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে।
যদিও নানা বাধার কারণে পাহাড়ি আট ছড়ার পানি যথাযথভাবে জলকদর খালে পৌঁছাতে পারে না। এছাড়া অধিকাংশ স্লুইচগেট নানাভাবে দখল কিংবা বন্ধ হয়ে আছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই দেখা দিচ্ছে বন্যা। এতে কৃষকদের ফসলি জমি তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ জনগণও।
জানা যায়, অতীতে এটি বাঁশখালীর জন মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতো। বাঁশখালী থেকে ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে কাউকে চট্টগ্রাম যেতে হলে নিশি যাপন করে অপেক্ষা করতে হতো বাংলা বাজার ঘাট, চৌধুরী ঘাটসহ বিভিন্ন ঘাটে ঘাটে। জোয়ার ভাটার সময় নির্ধারণ করে গভীর রাত থেকে কাক ডাকা ভোর পর্যন্ত কোলাহল মুখর থাকতো জলকদর খালের বিভিন্ন ঘাট। সে সময় ধান, চাল, লবণ, মাছ, শাক-সবজি ও মাতামহুরী থেকে আনা বাঁশের বাণিজ্যে মুখর থাকতো জলকদর খাল। কিন্তু সেই ঐতিহ্যবাহী জলকদরখাল কালের বিবর্তনে হারিয়েছে তার রূপ ও যৌবন। এখন জলকদর খালকে অনেকটা মৃতই বলা যায়।
বর্তমানে জলকদর খালকে ঘিরে উপজেলার শেখেরখীল ফাঁড়িরমুখ, বাংলা বাজার ঘাট, জালিয়াখালী নতুনবাজার ঘাট ইকোনমিক জোনে পরিণত হয়েছে। জেলেরা সাগর থেকে মাছ ধরে ভিড় জমায় এসব ঘাটে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জলকদরের দু’পাশের বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। বাঁধের নিম্ন সীমানা জলের স্বাভাবিক সীমায় মিলিত হয়েছে। দখলে দূষণে নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পতিত হচ্ছে। খালের উভয় তীরের দীর্ঘ ৩২ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। তাছাড়া নিত্যনৈমিত্য চলছে দখলের হিড়িক। অন্যদিকে জলকদর খালের অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার ফলে জেলে পল্লীর বাসিন্দারাও কাঁদছে নিরবে, নিভৃতে। যেন দেখার কেউ নেই।
স্থানীয়রা জানান, একসময় বাঁশখালীর ব্যবসায়ীরা নৌকা বা সাম্পান যোগে চট্টগ্রাম থেকে শঙ্খ নদী ও জলকদর খাল হয়ে বিনা বাধায় সব ধরণের মালামাল নিয়ে আসতেন। এখন সেই ধারা অব্যাহত থাকলেও খালের অধিকাংশ অংশ দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে আগের মতো সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।
দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে এখানকার উৎপাদিত ফসল রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠাতে গিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো ভোগান্তির মুখে পড়ছে। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের পানি দ্রুত সরে যেতে না পেরে জলাবদ্ধতা কিংবা বন্যায় পরিণত হয় আশপাশের এলাকায়। ফলে ডুবে যায় নিম্নাঞ্চল।
পানি উন্নয়ন বোর্ডর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী প্রকাশন চাকমা মহানগর নিউজকে বলেন, ‘ ঐতিহ্যবাহী জলকদর খালের অবৈধ দখল ও গড়ে উঠা স্থাপনা উচ্ছেদের তালিকা করা হয়েছে। সরকার প্রতি জেলায় একটি করে ঐতিহ্যবাহী খাল সংস্কারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে বাঁশখালীর জলকদর খালটিও রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের একটি প্রকল্প নিশ্চিতে আছে। জলকদর খালের দু’পারের ভাঙনের কাজ সংস্কার করা হবে। নদী রক্ষার কাজসহ এসব বিষয় মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন।’
কবে নাগাদ জলকদরের ভাঙনরোধে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টেইকসই কাজ করতে অনুমোদন হওয়া লাগে। বড় আকারের কাজ এ মুহূর্তে সম্ভব না। বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে অতীব জরুরী কাজগুলো দ্রতই সমাধান করা হবে।’
তবে জলকদরের দুর্বল বাঁধ সংস্কারের একটি তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
এআই