
পৃথিবীর বুকে নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে মানুষকে কত বিপ্লব, সংগ্রাম করতে হয়েছে যুগের পরে যুগ। শুধু একখণ্ড মুক্ত মানচিত্রের আশায় কত জীবন যে ঝরে গেছে তার হিসেব নেই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশ শত্রুমুক্ত করেছে ছাত্র-শিক্ষক, যুবক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, সেনাবাহিনীর জোয়ান, কৃষক-শ্রমিক তথা স্বাধীনতাকামী মানুষ। এ যুদ্ধে অনেক রক্তক্ষয় ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলাদেশ।
সেই যুদ্ধের গল্প তো আমরা অনেকই শুনেছি। কিন্তু এটা কি জানি, দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধে বড়দের মতো লড়াই করেছে অগণিত শিশু-কিশোরও? তারা কখনও সরাসরি যুদ্ধ করেছে, কখনও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। কেউ কেউ জীবনবাজি রেখে গ্রেনেড হাতে ছুটে গেছে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে। পলকেই উড়িয়ে দিয়েছে শত্রুদের আস্তানা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখই ছিল শিশু-কিশোর। আর যে সব নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল কিশোরি। তাই, মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের অবদান কিছুতেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করা দুরন্ত এবং দুর্ধর্ষ কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো সপ্তম পর্ব।
আনোয়ার
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন কিশোর আনোয়ার হোসেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে তিনিও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে জুলাই মাসে দেশে আসেন। ৯ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টরে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। পরবর্তীতে এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের (বীর উত্তম, পরে মেজর, বর্তমানে রাজনীতিক ও ব্যারিস্টার) নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর অধীনে যুদ্ধ করেন।
বরিশাল সদর থেকে উত্তরে গৌরনদী। মুক্তিযুদ্ধকালে এ এলাকার বিভিন্ন নদী দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রসদবাহী লঞ্চ কয়েক দিন পর পর চলাচল করত। লঞ্চের আগে-পিছে থাকত বিশেষ জলযান। পাকিস্তানি মিলিশিয়ারা ওই জলযানে করে লঞ্চ পাহারা দিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যেত।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে কিশোর আনোয়ার হোসেনসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা গৌরনদী এলাকায় অবস্থান নেন। একদিন ভোরে তাঁর দলনেতা খবর পান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য রসদবাহী একটি লঞ্চ ওই এলাকার নদী দিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা দলনেতার নির্দেশে দ্রুত তৈরি হয়ে নদীর তীরে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে লঞ্চটির জন্য অপেক্ষায় থাকেন। একটু পর দেখতে পেলেন লঞ্চটি এগিয়ে আসছে।
নদীর তীরে আনোয়ার হোসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছিলেন আড়ালে। পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও সহযোগী কেউ তাঁদের দেখতে পায়নি। নদীর ওই স্থানটি ছিল কিছুটা সরু। লঞ্চ অস্ত্রের আওতার মধ্যে আসামাত্রই গর্জে ওঠে আনোয়ারদের অস্ত্র। পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও তাদের বাঙালি সহযোগীরাও পাল্টা গুলি শুরু করে। তবে ওরা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চ ও বিশেষ জলযান লক্ষ্য করে দু-তিনটি মর্টারের গোলাও ছোঁড়েন। এতে পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও সহযোগীরা ভয়ে লঞ্চ ফেলে বিশেষ জলযানে করে পালিয়ে যায়।
এর কিছুদিন পর আগস্ট মাসে একদিন আনোয়ার হোসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা পাতারহাটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি গানবোটে হামলা করেন। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা হামলা করে। তখন দু’পক্ষে অনেকক্ষণ যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক গোলাগুলি করে তীরে নামে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভাঙার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে তিন-চারজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানিরা গানবোটে ফিরে যায় এবং গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে আনোয়ার হোসেন ও তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা যথেষ্ট বীরত্ব প্রদর্শন করেন। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের কারও কোনও ক্ষতি হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আনোয়ার হোসেনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। চাকরিতে থাকা অবস্থায় মারা যান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তাঁর পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামে। বাবার নাম আমির হোসেন, মা আমেনা বেগম। স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম। তাঁদের তিন মেয়ে, দুই ছেলে।
লেখক : গল্পকার ও সাংবাদিক।
এআই