সোমবার ০২ অক্টোবর ২০২৩

| ১৬ আশ্বিন ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো কিশোরযোদ্ধার গল্প—পর্ব ৬

প্রকাশের সময়: ১৬:০৩, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

সরোজ আহমেদ

একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো কিশোরযোদ্ধার গল্প—পর্ব ৬

পৃথিবীর বুকে নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে মানুষকে কত বিপ্লব, সংগ্রাম করতে হয়েছে যুগের পরে যুগ। শুধু একখণ্ড মুক্ত মানচিত্রের আশায় কত জীবন যে ঝরে গেছে তার হিসেব নেই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশ শত্রুমুক্ত করেছে ছাত্র-শিক্ষক, যুবক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, সেনাবাহিনীর জোয়ান, কৃষক-শ্রমিক তথা স্বাধীনতাকামী মানুষ। এ যুদ্ধে অনেক রক্তক্ষয় ও  ত্যাগ-তিতিক্ষার পর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলাদেশ।

সেই যুদ্ধের গল্প তো আমরা অনেকই শুনেছি। কিন্তু এটা কি জানি, দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধে বড়দের মতো লড়াই করেছে অগণিত শিশু-কিশোরও? তারা কখনও সরাসরি যুদ্ধ করেছে, কখনও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। কেউ কেউ জীবনবাজি রেখে গ্রেনেড হাতে ছুটে গেছে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে। পলকেই উড়িয়ে দিয়েছে শত্রুদের আস্তানা।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখই ছিল শিশু-কিশোর। আর যে সব নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল কিশোরি। তাই, মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের অবদান কিছুতেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। 

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করা দুরন্ত এবং দুর্ধর্ষ কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো ষষ্ঠ পর্ব। 

রমজান

আজ জানবো নারায়ণগঞ্জ গোদনাইলের সাহসী কিশোর এহসান কবির রমজানের যুদ্ধজয়ের কাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকসেনারা পাগলা কুকুরের মত আচরণ শুরু করে। নির্বিচারে মানুষ হত্যা, বাড়িঘর জ্বালাও পোড়াও যজ্ঞে মেতেছে। ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোদনাইল বাসস্ট্যান্ডসহ রমজানদের বাড়িও পুড়িয়ে দেয় । ওই রাতে আশপাশের আরও বহু বাড়িঘর আগুনে ছাই করে দেয় পাকিস্তানের বর্বরবাহিনী। গ্রামজুড়ে আতঙ্ক আর আতঙ্ক। দিনে যেমন তেমন রাত এলেই কারও দেহে আর প্রাণ থাকে না, কখন কী ঘটে এই ভাবনায়। এই অবস্থায় ঘরে বসে থাকার জো নেই। মার খেয়ে মরার চেয়ে মেরে মরা অনেক ভাল। কিশোর রমজানের মনে জেদ চাপে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে যুদ্ধ করে মরবে। কিন্তু যুদ্ধে অংশ নিতে হলে প্রশিক্ষণ চাই, আর প্রশিক্ষণ নিতে হলে ভারতে যেতে হবে। একে তো বয়স কম। আবার টাকারও দরকার। 

ইতোমধ্যে গোদনাইল গ্রামের অনেকে প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে চলে গেছেন। শুনে রমজানের খুব অভিমান হলো। অনেকের সঙ্গে তাঁর এত ভাল সম্পর্ক, অথচ কেউ তাঁকে সঙ্গে নিল না। রমজান সিদ্ধান্ত নিলেন, যেকোনো উপায়ে তিনিও ভারত যাবেন। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো, পাশের একটি বাড়িতে তাঁদের বেশ কিছু পরিমাণ চাল রাখা আছে। তিনি সেখান থেকে গোপনে কয়েক মণ চাল বিক্রি করে দিলেন। এবার চাল বিক্রির টাকা নিয়ে রওয়ানা হলেন ভারতে। পথঘাট চেনা নেই তো কী হয়েছে, মনোবলই আসল। পথে ঘাটে ভারতের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়া মানুষের অভাব নেই। তাদের সঙ্গে লঞ্চে করে চলে গেলেন কুমিল্লার রামকৃষ্ণপুর। সেখানে দেখা হয়ে যায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আবদুল মতিনের সঙ্গে। রমজান তাঁরই দলের কর্মী। আবদুল মতিন সাহেব রমজানকে দেখে বললেন, তুই বাড়ি ফিরে যা। খামোখা কষ্ট করে ভারতে গিয়ে কাজ নেই। তোর যা বয়স, ওরা তোকে ভর্তি করাবে না। কিন্তু রমজানের সাফ জবাব, চেষ্টা করতে আপত্তি কী।

এরপর মতিনের সঙ্গে ভারতের আগরতলা চলে গেলেন রমজান। সেখানে গিয়ে মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, অধ্যাপক মোজাফ্ফরসহ ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা-কর্মীদের দেখা পেলেন। গোদনাইল এলাকার আসাদ আলী মাস্টারকেও দেখলেন। এতে রমজানের মনোবল আরও বেড়ে গেল। 

আগরতলা ক্রাফট হোস্টেলে কয়েকদিন অবস্থানের পর প্রশিক্ষণের জন্য মতিনসহ একটি দল পাঠানো হলো বড়দুয়ারী ক্যাম্পে। আরেকটি দলের সঙ্গে রমজানকে পাঠানো হলো পঞ্চবটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। সেখানে এক মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে ২৮ জুন যুদ্ধের মাঠে ফিরে আসেন কিশোর রমজান।

দেশে ফিরে রমজানরা প্রথম অপারেশন করেন চিত্তরঞ্জন কটন মিলের কাছে চৌধুরী বাড়ির ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। জুলাই মাসের ১২ তারিখ রাতে এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে উড়িয়ে দেন বিশাল ট্রান্সফরমারটি। এটা খুব বড় অপারেশন না হলেও এই বিস্ফোরণ ঘটানোর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানিদের বুঝিয়ে দেওয়া যে, মুক্তিযোদ্ধারা সক্রিয়। যেকোনো মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের শিকার হতে পারে তারা।  

রমজানদের পরবর্তী অপারেশন জেলেপাড়ার রেলব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া। পাকিস্তানি বাহিনী আদমজীতে মালামাল পরিবহনে ব্রিজটি ব্যবহার করতো। সুতরাং ব্রিজটি ধ্বংস করে দিতে পারলে ওদের যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।

২৬ জুলাই আনুমানিক রাত ১২টা। ১৪ জনকে তিনভাগে ভাগ করা হলো। ব্রিজের উত্তর দিকে একটা গ্রুপ, দক্ষিণ দিকে একটি গ্রুপ কড়া পাহারায়। উত্তর দিকে ছিলেন রমজান। ব্রিজের একদিকে এক্সপ্লোসিভ সেট করা হলো। দুই মিনিটে টাইম ফিক্সড করে দিয়ে কিছুদূর আসতেই বিস্ফোরণ ঘটে। ব্রিজটি উড়ে যায়। আর রমজানরা নিরাপদে ফিরে আসেন আস্তানায়।

এবার উড়িয়ে দিতে হবে ফতুল্লার রেলওয়ে ব্রিজ। তবে কাজটা সহজ ছিল না। কারণ ব্রিজটি সবসময় পাহারায় থাকতো রাজাকারের দল। তারপরও ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় অপারেশন চালানো হয়। বেশ চাঞ্চল্যকর ছিল সেই অপারেশন। তাও তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে অপারেশন চালান রমজানরা। সিদ্ধান্ত হয়, একটা গ্রুপ ব্রিজ পাহারারত রাজাকারদের আত্মসমর্পন করানোর ব্যবস্থা করবে। একটি গ্রুপ বিস্ফোরকদ্রব্য সেট করবে। অপর গ্রুপ থাকবে কভারিং ফায়ার করার জন্য। 

ব্রিজের কাছাকাছি একটা বটগাছ ছিল। সেখান থেকে সামান্য দূরে ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। সুতরাং অধিক সতর্ক হয়ে প্রতিটি কাজ করা চাই। 

রমজানদের গ্রুপ ক্রলিং করে উত্তর দিক থেকে আস্তে আস্তে রাজাকারদের কাছাকাছি পৌঁছে যান। সেখানে ৬-৭ জন রাজাকার ছিল। তাদের ধরে ফেলেন রমজানরা। কিন্তু অন্ধকারে এক ফাঁকে এক রাজাকার পালিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পের দিকে ছুটে যায়। ফলে অপারেশনে বিলম্ব হলে সবাই মারা পড়ার আশঙ্কা। তড়িঘড়ি করে বিস্ফোরক সেট করে দিয়ে সবাই নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলেন। এ সময় দেখা গেল পালিয়ে যাওয়া রাজাকার ৬-৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত। চরম মুহূর্ত। রমজানদের মাঝে ভীষণ উত্তেজনা। কখন ঘটে বিস্ফোরণ। এ কথা ভাবতেই ধ্রুম করে ঘটে গেল কাঙ্খিত ঘটনা। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে রাজাকারসহ পাক হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা নিহত হয় ঘটনাস্থলেই।  

কিন্তু রমজানরা তখনও জানতেন না, আরও মজার এবং বড় ধরনরে কিছু ঘটতে যাচ্ছে। বিস্ফোরণের পর পরই ব্রিজে এসে যায় ট্রেন। যা নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা যাচ্ছিল। ওই ট্রেনে যাত্রী ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্য। চোখের পলকে সেনাবাহিনীসহ ট্রেনটি উড়ে যায়। অন্তত দশ পাকিস্তানি সৈন্য সেখানে নিহত হয়। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই অপারেশন যে এত সহজে সফল করা সম্ভব হবে তাঁদের কল্পনায়ও ছিল না। তাও এক ঢিলে দুই পাখি মারার মত ঘটনা। রমজানদের মাথায়ও ছিল না, ব্রিজ ধ্বংস করতে গিয়ে সেনাবাহিনী বহনকারী আস্ত একটা ট্রেনও উড়ে যাবে। 

ওই ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার কারণে নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে রেলপথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। শুধু তাই নয়, এই অপারেশনের খবর বিবিসি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণীসহ বিভিন্ন রেডিওতে সম্প্রচারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। রমজানদের এই অপারেশন সারাদেশের সকল মুক্তিযোদ্ধার মনোবল বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। 

এআই