সোমবার ০২ অক্টোবর ২০২৩

| ১৬ আশ্বিন ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
১৫:৩২, ২৭ জানুয়ারি ২০২২

সরোজ আহমেদ

একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো কিশোরযোদ্ধার গল্প—পর্ব ৫

প্রকাশের সময়: ১৫:৩২, ২৭ জানুয়ারি ২০২২

সরোজ আহমেদ

একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো কিশোরযোদ্ধার গল্প—পর্ব ৫

পৃথিবীর বুকে নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে মানুষকে কত বিপ্লব, সংগ্রাম করতে হয়েছে যুগের পরে যুগ। শুধু একখণ্ড মুক্ত মানচিত্রের আশায় কত জীবন যে ঝরে গেছে তার হিসেব নেই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশ শত্রুমুক্ত করেছে ছাত্র-শিক্ষক, যুবক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, সেনাবাহিনীর জোয়ান, কৃষক-শ্রমিক তথা স্বাধীনতাকামী মানুষ। এ যুদ্ধে অনেক রক্তক্ষয় ও  ত্যাগ-তিতিক্ষার পর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলাদেশ।

সেই যুদ্ধের গল্প তো আমরা অনেকই শুনেছি। কিন্তু এটা কি জানি, দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধে বড়দের মতো লড়াই করেছে অগণিত শিশু-কিশোরও? তারা কখনও সরাসরি যুদ্ধ করেছে, কখনও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। কেউ কেউ জীবনবাজি রেখে গ্রেনেড হাতে ছুটে গেছে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে। পলকেই উড়িয়ে দিয়েছে শত্রুদের আস্তানা।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখই ছিল শিশু-কিশোর। আর যে সব নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল কিশোরি। তাই, মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের অবদান কিছুতেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। 

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করা দুরন্ত এবং দুর্ধর্ষ কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো পঞ্চম পর্ব। 

সোলায়মান

দিনাজপুরের সন্তান দুরন্ত যোদ্ধা মোহাম্মদ সোলায়মান। স্বাধীনতা যুদ্ধের যখন দামামা বেজে ওঠে তখন তাঁর বয়স মাত্র ১২ বছর। এত কম বয়সে যুদ্ধে অংশ নেওয়া কিংবা অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করার ঘটনা বিরল। তবে এই কিশোরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ সহজে ঘটেনি। যুদ্ধ চলাকালীন একদিন পশ্চিম দিনাজপুরের ৭ নম্বর সেক্টরের একটি ক্যাম্পে নীরবে ঢুকে পড়েন সোলায়মান। এসময় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁকে ধরে ফেলেন। এরপর চোর ভেবে চলে বেধড়ক মারধর। সোলায়মানের কান্না শুনে কমান্ডার হামিদুল হোসেন তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন, মুক্তিযোদ্ধারা একজন কিশোরকে মারধর করছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ঘটনা কী জানতে চাইলেন। 

এসময় কিশোর সোলায়মান দৌঁড়ে এসে কমান্ডারের পা জড়িয়ে ধরে বলেন, স্যার আমি চোর। আমার বাবাও চোর ছিলেন। বাবাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে। তাই আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য এখানে এসেছি। 

শুনে কমান্ডার বললেন, তুই কীভাবে যুদ্ধ করবি? তোর চেয়ে তো রাইফেলের ওজনই বেশি। তখন কিশোর সোলায়মান জবাব দিলেন, না স্যার, আমি পারবো। সেদিন সোলায়মানের আগ্রহ এবং সাহসিকতা দেখে তাঁকে প্রশিক্ষণ দিতে সহযোদ্ধাদের আদেশ দেন কমান্ডার। 

যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে কিশোর সোলায়মান মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। বয়সে ছোট বলে তাঁকে সবাই আদর করে ‘সলো’ বলে ডাকতেন। প্রথম অপারেশন সফলতার সঙ্গে শেষে করে ক্যাম্পে ফিরে এসে সহযোদ্ধারা কমান্ডারের কাছে স্বীকার করলেন, সলো 
ভাল যুদ্ধ করে এবং খুব সাহসী ছেলে। শুনে সলোকে জড়িয়ে ধরে বাহবা দিলেন কমান্ডার। 

এরপর নভেম্বরের মাঝামাঝি মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী মিলিতভাবে আক্রমণ করতে যান পশ্চিম দিনাজপুরের মোহনপুরে। ওই দলে কিশোর সোলায়মানও ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের স্থান থেকে ১০০ গজ দূরে থাকতে ভারতীয় মেজর বললেন, সামনে আর যাওয়া যাবে না। আমরা এখান থেকে বাইনোকুলার দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবো। 
মেজরের এই কথা শুনে সলো কমান্ডারকে বললেন, মেজর সাহেব যাই বলুক, আমি গিয়ে দেখে আসি ওরা কী করছে। সলোর কথাটা মেজর সাহেবের কানে যেতেই ধমক দিয়ে বললেন, না। আর এক পা সামনে গেলেই মারা পড়বে। 

তবুও সহসী সলো মেজরের নিষেধ না শুনে রাইফেলটা কমান্ডারের কাছে জমা দিয়ে চলে গেলেন চুপি চুপি। তার একটু পর পাকিস্তানি ক্যাম্পের দিকে গুলির শব্দ শোনা গেল। তখন সহযোদ্ধারা সবাই ভেবে নেন সলোকে পাকিস্তানি আর্মিরা হয়তো মেরে ফেলেছে। 

কিন্তু প্রায় ৪৫ মিনিট পর সলো জীবিত ফিরে আসলে সবাই অবাক! সলো কমান্ডারকে বললেন, স্যার আমি তো মানুষটা চোর। বাঙ্কারে ঢুকে ট্রানজিস্টর ও রাইফেল দুটি চুরি করে নিয়ে এসেছি। আর বাঙ্কারে একটি গ্রেনেড রেখে এসেছি। যে ওই বাঙ্কারে ঢুকবে সাথে সাথে মারা যাবে। সবাই সলোর কথা শুনে আরও অবাক। কমান্ডার সলোকে জড়িয়ে ধরে বললেন, সলো তুই কেমনে পারলি? সলো হেসে জবাব দিলেন, আমার চুরির দশ বছরের অভিজ্ঞতা আছে না স্যার।

এভাবে আরও অনেক অপারেশনে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম অবদান রাখেন বারো বছরের কিশোর মোহাম্মদ সোলায়মান ওরফে সলো।  

আরও পড়ুন :

এআই