সোমবার ০৫ জুন ২০২৩

| ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
১৫:৫৪, ২০ জানুয়ারি ২০২২

সরোজ আহমেদ

একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো  কিশোরযোদ্ধার গল্প—পর্ব ৪

প্রকাশের সময়: ১৫:৫৪, ২০ জানুয়ারি ২০২২

সরোজ আহমেদ

একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো  কিশোরযোদ্ধার গল্প—পর্ব ৪

পৃথিবীর বুকে নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে মানুষকে কত বিপ্লব, সংগ্রাম করতে হয়েছে যুগের পরে যুগ। শুধু একখণ্ড মুক্ত মানচিত্রের আশায় কত জীবন যে ঝরে গেছে তার হিসেব নেই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশ শত্রুমুক্ত করেছে ছাত্র-শিক্ষক, যুবক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, সেনাবাহিনীর জোয়ান, কৃষক-শ্রমিক তথা স্বাধীনতাকামী মানুষ। এ যুদ্ধে অনেক রক্তক্ষয় ও  ত্যাগ-তিতিক্ষার পর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলাদেশ।

সেই যুদ্ধের গল্প তো আমরা অনেকই শুনেছি। কিন্তু এটা কি জানি, দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধে বড়দের মতো লড়াই করেছে অগণিত শিশু-কিশোরও? তারা কখনও সরাসরি যুদ্ধ করেছে, কখনও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। কেউ কেউ জীবনবাজি রেখে গ্রেনেড হাতে ছুটে গেছে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে। পলকেই উড়িয়ে দিয়েছে শত্রুদের আস্তানা।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখই ছিল শিশু-কিশোর। আর যে সব নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল কিশোরি। তাই, মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের অবদান কিছুতেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। 

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করা দুরন্ত এবং দুর্ধর্ষ কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো চতুর্থ  পর্ব। 

এসএম মওলা 

এবার শোনাবো কিশোরযোদ্ধা এসএম মওলা ওরফে শফিকুন নূর মাওলার গল্প। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে তখন তিনি ঢাকার তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী। অসীম সাহসী এই কিশোর দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ঘর ছেড়ে চলে যান ভারতে। সেখানে গিয়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌকমাণ্ডো দলে যোগ দেন। এরপর দেশে ফিরে সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে শুরু করেন দুঃসাহসিক অভিযান।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের একদিন চট্টগ্রাম নৌবন্দরের বহির্নোঙ্গরে দুঃসাহসী এক অপারেশনের জন্য নৌকমান্ডোরা রেকি করেন। কিন্তু রেকিতে তাঁদের একটা বড় ভুল ছিল। সে ভুলটা হলো দূরত্বের হিসাব। তাঁরা অনুমান করেছিলেন বহির্নোঙ্গরের দূরত্ব দেড়-দুই মাইলের বেশি হবে না। কিন্তু বাস্তবে এই দূরত্ব ছিল তিন-চারগুণেরও বেশি। জলপথের দূরত্ব হিসাব করার ব্যাপারে তাঁরা অভিজ্ঞ ছিলেন না। নৌকামান্ডোরা তাঁদের অজ্ঞাতেই বিরাট এই ভুল করে ফেলেন। সহযোদ্ধা নৌকমান্ডোদের সঙ্গে এসএম মওলা সাঁতার কেটে যেতে থাকলেন সমুদ্রের গভীরে। পানির মধ্যে তাঁদের পায়ের ফিনস অনবরত উঠানামা করছিল। এক ঘণ্টার বেশি সময় সাঁতরিয়ে তাঁরা মাথা তুলে তাকালেন লক্ষ্যস্থলের দিকে। দেখলেন লক্ষ্যস্থল তখনও অনেক দূরে। আরও আধা ঘণ্টা সবাই সমানতালে সাঁতার কাটলেন। তারপরও দূরত্ব কমে না। আর কতক্ষণই বা সাঁতার কাটা যায়। ক্লান্ত হয়ে পড়েন সবাই। সামনে কিংবা পেছনে যাওয়ার শক্তিও নেই কারও। চরম দুঃসাহস প্রদর্শন করেও ব্যর্থ হলেন তাঁরা। শুধু ব্যর্থ হলেন তা নয়, শেষ পর্যন্ত এই অভিযান শেষ হয় ট্র্যাজিক ঘটনার মধ্য দিয়ে।

জোয়ারের প্রবল ধাক্কায় পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় সমুদ্রের তীরে পৌঁছান। তখন তাঁদের অনেকের জ্ঞান ছিল না। নয়জনের মধ্যে এসএম মওলাসহ চারজন মৃতপ্রায় অবস্থায় যেখানে ভেসে উঠেন সেখানে ছিল পাক সেনাদের সশস্ত্র প্রহরা। পাক সেনারা তাঁদের দেখে ফেলে। এরপর তাঁদের আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে। সেখানে ব্যাপক নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নির্মম নির্যাতনে একজন (মোহাম্মদ হোসেন, বীর প্রতীক) মারা যান। এসএম মওলাসহ তিনজনকে পরে ঢাকা সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেও চলে তাঁদের উপর ব্যাপক নির্যাতন। এই নির্যাতন চলে অনেক দিন। স্বাধীনতার পর ছাড়া পান তাঁরা।

মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এসএম মওলাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৪ সালে ঢাকায় এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান অকুতোভয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

 তাঁর পৈতৃক বাড়ি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেব গ্রামে। তবে তিনি বাস করতেন চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার রাঙামাটিয়া গ্রামে। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বর্তমানে এখানেই বসবাস করেন। গোলাম মওলার বাবার নাম নূর মোহাম্মদ মাওলা। মা সুফিয়া বেগম। স্ত্রী জান্নাতুন নাহার মাওলা। তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে।

এআই