সোমবার ০৫ জুন ২০২৩

| ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
১৪:১৬, ৬ জানুয়ারি ২০২২

সরোজ আহমেদ

একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো কিশোরযোদ্ধার গল্প—পর্ব ২

প্রকাশের সময়: ১৪:১৬, ৬ জানুয়ারি ২০২২

সরোজ আহমেদ

একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো কিশোরযোদ্ধার গল্প—পর্ব ২

পৃথিবীর বুকে নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে মানুষকে কত বিপ্লব, সংগ্রাম করতে হয়েছে যুগের পরে যুগ। শুধু একখণ্ড মুক্ত মানচিত্রের আশায় কত জীবন যে ঝরে গেছে তার হিসেব নেই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশ শত্রুমুক্ত করেছে ছাত্র-শিক্ষক, যুবক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, সেনাবাহিনীর জোয়ান, কৃষক-শ্রমিক তথা স্বাধীনতাকামী মানুষ। এ যুদ্ধে অনেক রক্তক্ষয় ও  ত্যাগ-তিতিক্ষার পর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলাদেশ।

সেই যুদ্ধের গল্প তো আমরা অনেকই শুনেছি। কিন্তু এটা কি জানি, দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধে বড়দের মতো লড়াই করেছে অগণিত শিশু-কিশোরও? তারা কখনও সরাসরি যুদ্ধ করেছে, কখনও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। কেউ কেউ জীবনবাজি রেখে গ্রেনেড হাতে ছুটে গেছে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে। পলকেই উড়িয়ে দিয়েছে শত্রুদের আস্তানা।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখই ছিল শিশু-কিশোর। আর যে সব নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল কিশোরি। তাই, মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের অবদান কিছুতেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। 

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করা দুরন্ত এবং দুর্ধর্ষ কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো দ্বিতীয় পর্ব।

বিচ্ছু লালু 

শহীদুল ইসলাম ওরফে বিচ্চু লালু। যিনি দেশের সর্বকনিষ্ঠ বীরপ্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। তিনি ছিলেন টাঙ্গাইলের গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা। যুদ্ধ শুরুর দিকে পিতৃ-মাতৃহীন লালু পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেয় কেরামজানী জাওয়াল স্কুল মাঠে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। এই সুবাদে দুরন্ত লালু সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কাজে সাহায্য করতেন। এক সময় ছোট্ট লালু হয়ে উঠলেন সবার প্রিয় পাত্র। 

ক্যাম্পে কিছুদিন ছোটখাটো কাজ করার পর যুদ্ধ করার জন্য জেদ ধরলেন লালু। বড়রা শুনে হাসাহাসি করে। হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলে, এই একরত্তি ছেলে করবে যুদ্ধ? হাতে নেবে বন্দুক? ছুঁড়ে মারবে গ্রেনেড? আরও কত কথা! 

কিন্তু একরোখা লালুর মন নেই ওসবে। সে যুদ্ধে যাবে তো যাবেই। কারও কটু কথা তাকে পিছু হটাতে পারে না। মা-বাবাও নেই যে পেছন ফিরে তাকাবে। বড়দের যেখানে বুক কাঁপে, লালু সেখানে ডর-ভয় তোয়াক্কা না করে চলে যায় এলাকা ছেড়ে। অন্যত্র গিয়ে খুঁজে বের করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। দশ বছরের ছেলেটা ক্যাম্পে ঢুকেই চলে যায় কমান্ডারের সামনে। বুক ফুলিয়ে বলে, ‘আমি যুদ্ধ করব।’

মুক্তিবাহিনীর সেই দলের কমান্ডার আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী ছোট্ট একটি ছেলের ভয়ঙ্কর আবদার শুনে হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘তুমি তো বন্দুক আলগাইতে পারবা না, কী যুদ্ধ করবা খোকা? যাও, বাড়ি যাও। বড় হইলে যুদ্ধ কইরো।’

‘আমি ছোট বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করব।’ এই বলে লালু কান্নাকাটি শুরু করলেন। কমান্ডার তাঁর গায়ে হাত রাখলেন। লালু ফের বলে ওঠেন, ‘আমি যুদ্ধে যাব। আর দেশ স্বাধীন করেই বাড়ি ফিরব।’

কমান্ডার আবারও বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু লালু নাছোড়বান্দা। যুদ্ধ করবেনই। অবশেষে তাঁকে রেখে দেওয়া হয় ক্যাম্পে। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন লালু। তিনি এখন যোদ্ধা! ক্যাম্পে ফুটফরমাশ খাটেন। অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করেন। তবে এসবে মন নেই তাঁর। কীভাবে থাকবে? লালু তো এখানে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতেই এসেছেন। তাই কমান্ডারের দেওয়া কাজ সেরে প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ে গিয়ে হাজির হয়ে যান লালু। আবার কখনও কাজের ফাঁকেই অনুনয়-বিনয় করে সিনিয়রদের কাছ থেকে শিখে নেন যুদ্ধের কৌশল। 

অল্প দিনেই লালু শিখে যায় কীভাবে হামাগুড়ি দিতে হয়, কীভাবে অস্ত্র চালাতে হয়, গ্রেনেড ছুঁড়তে হয়, নিতে হয় শত্রুর গতিবিধির খবর। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পিচ্ছি লালু বড়দের কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে একদিন যুদ্ধে নেমে পড়েন। প্রতিটি অভিযানে পরিচয় দিলেন অসাধারণ বীরত্বের! 

১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর। গোপালপুরে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ বাধে মুক্তিযোদ্ধাদের। তুমুল লড়াই চলছিল। কিন্তু কোনভাবেই কর্তৃত্ব আনতে পারছিলেন না মুক্তিযোদ্ধারা। সে সময় এক অভিনব বুদ্ধি আঁটা হলো। মাত্র দশ বছরের লালুকে পাঠানো হলো পাক হানাদারদের ক্যাম্পে, ফুটফরমাশ খাটতে। করিৎকর্মা এবং বুদ্ধিমান লালু খুব সহজেই পাকবাহিনীর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হলেন। 

একদিন সুযোগ বুঝে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রাখা হলো পাক বাহিনীর ক্যাম্প। এ সময় লালু করলেন কী, ক্যাম্পের ভেতর ঢুকে গ্রেনেড হামলা করে ৮ পাকসেনাকে খতম করে দিলেন। অবশেষে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা গোপালপুরকে শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হন।  
ছোট্ট লালু লড়াই করেন গোপালপুর, ভুঞাপুর, মধুপুর ও নাগরপুরের বেশ কয়েকটি রণাঙ্গনে। প্রতিটি লড়াইয়ে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন দুরন্ত লালু ও তার সহযোদ্ধারা।

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলে আয়োজন করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার অনুষ্ঠান। সেদিন রাষ্ট্রপতির কাছে অস্ত্র জমা দিতে এলেন লালুও। এই অনুষ্ঠানে পিচ্চি লালুর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের বিবরণ শুনে বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত হয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসে তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর তাঁকে মঞ্চে নিয়ে বসালেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে আদর করে নাম দিলেন, ‘বীর বিচ্ছু লালু’। সাহস আর বীরত্বের জোরে এই পুঁচকে মুক্তিযোদ্ধা পেলেন বীরপ্রতীক খেতাব। 

২০০৯ সালের মে মাস পর্যন্ত লালু জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানা সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে। ২৫ মে বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছু লালু পরলোক গমন করেন।   

মহানগর নিউজ/এআই