রোববার ০১ অক্টোবর ২০২৩

| ১৬ আশ্বিন ১৪৩০

KSRM
মহানগর নিউজ :: Mohanagar News

প্রকাশের সময়:
১১:০৬, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১

সরোজ আহমেদ

একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো কিশোরযোদ্ধার গল্প—পর্ব ১

প্রকাশের সময়: ১১:০৬, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১

সরোজ আহমেদ

একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপানো কিশোরযোদ্ধার গল্প—পর্ব ১

পৃথিবীর বুকে নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে মানুষকে কত বিপ্লব, সংগ্রাম করতে হয়েছে যুগের পরে যুগ। শুধু একখণ্ড মুক্ত মানচিত্রের আশায় কত জীবন যে ঝরে গেছে তার হিসেব নেই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশ শত্রুমুক্ত করেছে ছাত্র-শিক্ষক, যুবক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, সেনাবাহিনীর জোয়ান, কৃষক-শ্রমিক তথা স্বাধীনতাকামী মানুষ। এ যুদ্ধে অনেক রক্তক্ষয় ও  ত্যাগ-তিতিক্ষার পর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি, বাংলাদেশ।

সেই যুদ্ধের গল্প তো আমরা অনেকই শুনেছি। কিন্তু এটা কি জানি, দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধে বড়দের মতো লড়াই করেছে অগণিত শিশু-কিশোরও? তারা কখনও সরাসরি যুদ্ধ করেছে, কখনও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। কেউ কেউ জীবনবাজি রেখে গ্রেনেড হাতে ছুটে গেছে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে। পলকেই উড়িয়ে দিয়েছে শত্রুদের আস্তানা।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মধ্যে প্রায় ৪ লাখই ছিল শিশু-কিশোর। আর যে সব নারী সম্ভ্রম হারিয়েছিল তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল কিশোরি। তাই, মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের অবদান কিছুতেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। 

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করা দুরন্ত এবং দুর্ধর্ষ কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব।

কিশোরযোদ্ধা হামিদুল

বগুড়ার সন্তান এটিএম হামিদুল হোসেন। ১৯৭১ সালে সবেমাত্র হাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন। এরই মাঝে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। অসীম সাহসী এই কিশোর মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে। তবে যুদ্ধ করতে হলে প্রশিক্ষণ চাই। তাই প্রশিক্ষণ নিতে পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে যুদ্ধ করেন ৭ নম্বর সেক্টরের তপন সাব-সেক্টরে। 

১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বরে পরিকল্পনা করা হলো দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ করবে। সিদ্ধান্ত হলো, প্রথম আক্রমণের সম্মুখদল হিসেবে থাকবে মিত্রবাহিনীর দুটি দল। এই দুই দলের মধ্যে কিশোর এটিএম হামিদুল হোসেন তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে থাকবেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন। পেছনে থাকবে মিত্রবাহিনীর অপর দুটি দল। 

সকাল থেকে শুরু হয় যুদ্ধের প্রস্তুতি। সারাদিন কেটে যায় প্রস্তুত হতে। অস্ত্র, গোলাবারুদ সবই পরীক্ষা করে নেওয়া হলো। এরপর সবাই ঘুমোতে গেলেন। কারণ সারারাত জেগে কাটাতে হবে। রাত দশটার মধ্যে সবাই ঘুম থেকে উঠে এক ঘণ্টার মধ্যেই তৈরি হয়ে গেলেন। আক্রমণের জন্য যাত্রার নির্ধারিত সময় রাত এগারোটা। এফইউপিতে (ফর্মি আপ প্লেস) পৌঁছার সময় রাত সাড়ে চারটা। আক্রমণের সময় ভোর সাড়ে পাঁচটা।

শীতের অন্ধকার রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সেনারা অ্যাসেম্বলি এরিয়ায় সমবেত হলেন নির্ধারিত সময়েই। তখন রাত আনুমানিক তিনটা। সেখানে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি দিয়ে রওনা হলেন এফইউপির উদ্দেশে। তাঁরা খুব সতর্কভাবে এগোতে থাকলেন কোনও প্রকার শব্দ না করে। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী সব মিলে প্রায় ৭০০ জন। কারও মুখে কোনও কথা নেই। শুধু ইশারায় কাজ হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সেনারা এফইউপিতে অবস্থান নিলেন। তারপর সময় দ্রুত গড়াতে থাকে। টান টান উত্তেজনা। আক্রমণের সময় আর মাত্র তিন মিনিট। এটিএম হামিদুল হোসেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। অস্ত্র হাতে সবেমাত্র পা বাড়ালেন। এমন সময় নিস্তব্ধতা ভেদ করে বিকট শব্দ। আক্রমণের তখনও আড়াই মিনিট বাকি। এর মধ্যে উত্তেজনায় মিত্রবাহিনীর এক সৈনিকের হাত থেকে পিনখোলা গ্রেনেড মাটিতে পড়ে এই বিপত্তি। গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট শব্দে পাকিস্তানি সেনারা বুঝে গেল তাদের ওপর আক্রমণ আসন্ন। সঙ্গে সঙ্গে তারা আক্রমণ শুরু করল। ওদের সব বাঙ্কার থেকে মেশিনগান, লাইট মেশিনগান ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু। মাথার ওপর দিয়ে হাজার হাজার গুলি ছুটছে। 

এটিএম হামিদুল হোসেন তাতে এতটুকু বিচলিত হলেন না। সহযোদ্ধাদের নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে রইলেন। এমন সময় মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে শুরু হলো গোলাবর্ষণ প্রথম লেয়ার শেষ হওয়ামাত্র মুক্তিযোদ্ধারা এটিএম হামিদুল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জয় বাংলা’ চিৎকার দিয়ে গুলি করতে করতে অগ্রসর হলেন পাকিস্তানি অবস্থানের দিকে। শুরু হলো ডগফাইট। একটু পর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙ্কারগুলোতে গ্রেনেড চার্জ করতে শুরু করে দিলেন। কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। সেদিন সূর্য ওঠার আগেই ফুলবাড়ির অপারেশন শেষ হয়। এ যুদ্ধে আটজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

এটিএম হামিদুল হোসেন বেশ কয়েকটি যুদ্ধে সাহস, বীরত্ব ও রণকৌশল প্রদর্শন করে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত হন। দেশ স্বাধীনের তিন বছর পর ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে কমিশন্ড লাভ করেন। ১৯৮৯ সালে তাঁকে অকালীন অবসর দেওয়া হয়। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর।

এটিএম হামিদুল হোসেনের পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলার সদর উপজেলা। তবে বর্তমানে বাস করেন ঢাকায়। তাঁর বাবার নাম আবদুল আজিজ, মা মনোয়ারা হামিদ। স্ত্রী আজিজুন নেছা শাম্মী। তাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে।                       

মহানগর নিউজ/এআই